পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

v) NRW রবীন্দ্র-রচনাবলী এই গুরুঠাকুরের সঙ্গে বালককাল হইতে তিনি খেলা করিয়াছেন ; তখন হইতেই তাহাকে আপন মনপ্ৰাণ সমাপণ করিয়া দিয়াছেন । তখন আমার স্বামীকে ঠাকুর বোকা বলিয়া জানিতেন । সেইজন্য র্তাহার উপর বিস্তর উপদ্ৰব করিয়াছেন । অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিয়া পরিহাস করিয়া তাহাকে যে কত নাকাল করিয়াছেন তাহার *ीभां नाई । বিবাহ করিয়া এ সংসারে যখন আসিয়াছি তখন গুরুঠাকুরকে দেখি নাই । তিনি তখন কাশীতে অধ্যয়ন করিতে গিয়াছেন । আমার স্বামীই তাহাকে সেখানকার খরচ জোগাইতেন । গুরুঠাকুর যখন দেশে ফিরিলেন তখন আমার বয়স বোধ করি আঠারো হইবে । পনেরো বছর বয়সে আমার একটি ছেলে হইয়াছিল । বয়স কাচা ছিল বলিয়াই আমার সেই ছেলেটিকে আমি যত্ন করিতে শিখি নাই, পাড়ার সই-সাঙাতিদের সঙ্গে মিলিবার জন্যই তখন আমার মন ছুটিত । ছেলের জন্য ঘরে বাধা থাকিতে হয় বলিয়া এক-একসময় তাহার উপরে আমার রাগ হইত । হায় রে, ছেলে যখন আসিয়া পৌঁছিয়াছে, মা তখনো পিছাইয়া পড়িয়া আছে, এমন বিপদ আর কী হইতে পারে । আমার গোপাল আসিয়া দেখিল, তখনো তাহার জন্য ননী তৈরি নাই, তাই সে রাগ করিয়া চলিয়া গেছে- আমি আজও মাঠে ঘাটে তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি । ছেলেটি ছিল বাপের নয়নের মণি । আমি তাহাকে যত্ব করিতে শিখি নাই বলিয়া তাহার বাপ কষ্ট পাইতেন । কিন্তু, তাহার হৃদয় যে ছিল বোবা, আজ পর্যন্ত র্তাহার দুঃখের কথা কাহাকেও কিছু বলিতে পারেন নাই । মেয়েমানুষের মতো তিনি ছেলের যত্ন করিতেন । রাত্রে ছেলে কঁদিলে আমার অল্পবয়সের গভীর ঘুম তিনি ভাঙাইতে চাহিতেন না। নিজে রাত্রে উঠিয়া দুধ গরম করিয়া খাওয়াইয়া কতদিন খোকাকে কোলে লইয়া ঘুম পাড়াইয়াছেন, আমি তাহা জানিতে পারি নাই । তাহার সকল কাজই এমনি নিঃশব্দে। পূজাপার্বণে জমিদারদের বাড়িতে যখন যাত্রা বা কথা হইত। তিনি বলিতেন, “আমি রাত জাগিতে পারি না, তুমি যাও, আমি এখানেই থাকি।” তিনি ছেলেটিকে লইয়া না থাকিলে আমার যাওয়া হইবে না, এইজন্য র্তাহার ছুতা । আশ্চর্য এই, তবু ছেলে আমাকেই সকলের চেয়ে বেশি ভালোবাসিত ! সে যেন বুঝিত, সুযোগ পাইলেই আমি তাহাকে ফেলিয়া চলিয়া যাইব, তাই সে যখন আমার কাছে থাকিত তখনো ভয়ে ভয়ে থাকিত । সে আমাকে অল্প পাইয়াছিল বলিয়াই আমাকে পাইবার আকাঙক্ষণ তাহার কিছুতেই মিটিতে 5श्ठि ना | আমি যখন নাহিবার জন্য ঘাটে যাইতাম তাহাকে সঙ্গে লইবার জন্য সে আমাকে রোজ বিরক্ত করিত । ঘাটে সঙ্গিনীদের সঙ্গে আমার মিলনের জায়গা, সেখানে ছেলেকে লইয়া তাহার খবরদারি করিতে আমার ভালো লাগিত না । সেইজন্য পারতপক্ষে তাহাকে লইয়া যাইতে চাহিতাম না । সেদিন শ্রাবণ মাস। থাকে থাকে ঘন কালো মেঘে দুই-প্রহর বেলাটাকে একেবারে আগাগোড়া মুড়ি দিয়া রাখিয়াছে। স্নানে যাইবার সময় খোকা কান্না জুড়িয়া দিল । নিস্তারিণী আমাদের হেঁসেলের কাজ করিত, তাহাকে বলিয়া গেলাম, “বাছা, ছেলেকে দেখিয়ো, আমি ঘাটে একটা ডুব দিয়া আসি গে।” ঘাটে ঠিক সেই সময়টিতে আর কেহ ছিল না। সঙ্গিনীদের আসিবার অপেক্ষায় আমি সাতার দিতে লাগিলাম। দিঘিটা প্ৰাচীনকালের ; কোন রানী কবে খনন করাইয়াছিলেন তাই ইহার নাম রানীসাগর । সীতার দিয়া এই দিঘি এপার-ওপার করা মেয়েদের মধ্যে কেবল আমিই পরিতাম। বর্ষায় তখন কুলে কুলে জল । দিঘি যখন প্ৰায় অর্ধেকটা পার হইয়া গেছি। এমন সময় পিছন হইতে ডাক শুনিতে পাইলাম, “মা !” ফিরিয়া দেখি, খোকা ঘাটের সিঁড়িতে নামিতে নামিতে আমাকে ডাকিতেছে। চীৎকার করিয়া বলিলাম, “আর আসিস নে, আমি যাচ্ছি।” নিষেধ শুনিয়া হাসিতে হাসিতে সে আরো নামিতে লাগিল। ভয়ে আমার হাতে পায়ে যেন খিল ধরিয়া আসিল, পার হইতে আর পারিই না । চোখ