পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO রবীন্দ্র-রচনাবলী নয় বলিয়া ইনি পশ্চিমে গিয়া বাস করিতেছেন । সেখানে গরিব গৃহস্থের মতোই থাকেন। একটি মেয়ে দ্রা তার আর নাই। সুতরাং তাঁহারই পশ্চাতে লক্ষ্মীর ঘাটটি একবারে উপুড় করিয়া দিতে দ্বিধা হইবে R : এ-সব ভালো কথা । কিন্তু মেয়ের বয়স যে পনেরো, তাই শুনিয়া মামার মন ভার হইল । বংশে তো কোনো দোষ নাই ? না, দোষ নাই- বাপ কোথাও তার মেয়ের যোগ্য বর খুঁজিয়া পান না । একে তো বরের হাট মহার্ঘ, তাহার পরে ধনুক-ভাঙা পণ, কাজেই বাপ কেবলই সবুর করিতেছেন। কিন্তু মেয়ের বয়স সবুর করিতেছে না । যাই হোক, হরিশের সরস রসনার গুণ আছে । মামার মন নরম হইল । বিবাহের ভূমিকা-অংশটা নির্বিঘ্নে সমাধা হইয়া গেল। কলিকাতার বাহিরে বাকি যে পৃথিবীটা আছে সমস্তটাকেই মামা আন্ডামান দ্বীপের অন্তর্গত বলিয়া জানেন । জীবনে একবার বিশেষ কাজে তিনি কোন্নগর পর্যন্ত গিয়াছিলেন । মামা যদি মনু হইতেন তবে তিনি হাবড়ার পুল পার হওয়াটাকে তাহার সংহিতায় একেবারে নিষেধ করিয়া দিতেন । মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল, নিজের চোখে মেয়ে দেখিয়া আসিব । সাহস করিয়া প্ৰস্তাব করিতে পারিলাম না । কন্যাকে আশীৰ্বাদ করিবার জন্য যাহাকে পাঠানো হইল সে আমাদের বিনুদাদা, আমার পিস্ততো ভাই ! তাহার মত, রুচি এবং দক্ষতার 'পরে আমি ষোলো-আনা নির্ভর করিতে পারি । বিনুদা ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “মন্দ নয় হে ! খাটি সোনা বটে ।” বিনুদাদার ভাষাটা অত্যন্ত আঁট । যেখানে আমরা বলি চমৎকার', সেখানে তিনি বলেন "চলনসই’ । অতএব বুঝিলাম, আমার ভাগ্যে প্রজাপতির সঙ্গে পঞ্চশরের কোনো বিরোধ নাই । বলা বাহুল্য, বিবাহ-উপলক্ষে কন্যাপক্ষকেই কলিকাতায় আসিতে হইল। কন্যার পিতা শাস্তুনাথবাবু হরিশকে কত বিশ্বাস করেন তাহার প্রমাণ এই যে, বিবাহের তিন দিন পূর্বে তিনি আমাকে প্রথম চক্ষে দেখেন এবং আশীর্বাদ করিয়া যান । বয়স তার চল্লিশের কিছু এপারে বা ওপারে । চুল কঁচা, গোফে পাক ধরিতে আরম্ভ করিয়াছে মাত্র । সুপুরুষ বটে। ভিড়ের মধ্যে দেখিলে সকলের আগে তার উপরে চোখ পড়িবার মতো চেহারা । আশা করি, আমাকে দেখিয়া তিনি খুশি হইয়াছিলেন । বোঝা শক্ত, কেননা তিনি বড়োই চুপচাপ । যে দুটি-একটি কথা বলেন, যেন তাহাতে পুরা জোর দিয়া বলেন না । মামার মুখ তখন অনর্গল ছুটিতেছিল- ধনে মানে আমাদের স্থান যে শহরের কারও চেয়ে কম নয়, সেইটেকেই তিনি নানা প্রসঙ্গে প্রচার করিতেছিলেন । শম্ভুনাথবাবু এ কথায় একেবারে যোগই দিলেন না- কোনো ফাকে একটা ই বা ই কিছুই শোনা গেল না । আমি হইলে দমিয়া যাইতাম । কিন্তু, মামাকে দমানো শক্ত । তিনি শম্ভুনাথবাবুর চুপচাপ ভাব দেখিয়া ভাবিলেন, লোকটা নিতান্ত নিজীব, একেবারে কোনো তেজ নাই । বেহাই-সম্প্রদায়ের আর যাই থাক, তেজ থাকাটা দোষের, অতএব মামা মনে মনে খুশি হইলেন । শম্ভুনাথবাবু যখন উঠিলেন তখন মামা সংক্ষেপে উপর হইতেই তাকে বিদায় করিলেন, গাড়িতে তুলিয়া দিতে গেলেন না । পণ সম্বন্ধে দুই পক্ষে পাকাপাকি কথা ঠিক হইয়া গিয়াছিল। মামা নিজেকে অসামান্য চতুর বলিয়াই অভিমান করিয়া থাকেন । কথাবার্তায় কোথাও তিনি কিছু ফাক রাখেন নাই । টাকার অঙ্ক তো স্থির ছিলই, তার পরে গহনা কত ভরির এবং সোনা কত দরের হইবে সেও একেবারে বাধাৰ্বিাধি হইয়া গিয়াছিল ; আমি নিজে এ-সমস্ত কথার মধ্যে ছিলাম না ; জানিতাম না, দেনা-পাওনা কী স্থির হইল । মনে জানিতাম, এই স্থূল অংশটাও বিবাহের একটা প্রধান অংশ, এবং সে অংশের ভার র্যার উপরে তিনি এক কড়াও ঠকিবেন না । বস্তুত, আশ্চর্য পাকা লোক বলিয়া মামা আমাদের সমস্ত সংসারের প্রধান গর্বের সামগ্ৰী । যেখানে আমাদের কোনো সম্বন্ধ আছে সেখানে সর্বত্রই তিনি বুদ্ধির লড়াইয়ে