পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বিষয়ে ভাবে বাক্যে ছন্দে নিবিড় সম্মিলনের দ্বারা যদি এই কাব্যে একের রূপ পূর্ণ হয়ে দেখা দেয়, যদি সেই একের আবির্ভাবই চরম হয়ে আমাদের চিত্তকে অধিকার করে, যদি এই কাব্য খণ্ড খণ্ড হয়ে উল্কাবৃষ্টির দ্বারা আমাদের মনকে আঘাত না করতে থাকে, যদি ঐক্যরসের চরমতাকে অতিক্রম করে আর-কোনো উদ্দেশ্য উগ্র হয়ে না। ওঠে, তা হলেই এই কাব্যে আমরা সৃষ্টিলীলাকে স্বীকার করব । গোলাপ-ফুলে আমরা আনন্দ পাই। বর্ণে গন্ধে রূপে রেখায় এই ফুলে আমরা একের সুষমা দেখি । এর মধ্যে আমাদের আত্মারূপী এক আপনি আত্মীয়তা স্বীকার করে, তখন এর আর-কোনো মূল্যের দরকার হয় না । অন্তরের এক বাহিরের একের মধ্যে আপনাকে পায় বলে এরই নাম দিই। আনন্দরাপ । গোলাপের মধ্যে সুনিহিত সুবিহিত সুষমাযুক্ত যে-ঐক্য নিখিলের অন্তরের মধ্যেও সেই ঐক্য । সমস্তের সংগীতের সঙ্গে এই গোলাপের সুরটুকুর মিল আছে ; নিখিল এই ফুলের সুষমাটিকে আপন বলে গ্ৰহণ করেছে । এই কথাটাকে আর-এক দিক থেকে বোঝাবার চেষ্টা করি । আমি যখন টাকা করতে চাই তখন আমার টাকা করবার নানা প্রকার চেষ্টা ও চিন্তার মধ্যে একটি ঐক্য বিরাজ করে । বিচিত্ৰ প্ৰয়াসের মধ্যে একটিমাত্র লক্ষ্যের ঐক্য অর্থকামীকে আনন্দ দেয় । কিন্তু, এই ঐক্য আপন উদ্দেশ্যের মধ্যেই খণ্ডিত, নিখিলের সৃষ্টিলীলার সঙ্গে যুক্ত নয় । ধনলোভী বিশ্বকে টুকরো টুকরো করে খাবলে নিয়ে আপন মুনফার মধ্যে সঞ্চিত করতে থাকে। অর্থকামনার ঐক্য বড়ো ঐক্যকে আঘাত করতে থাকে । সেইজন্যে উপনিষদ যেখানে বলেছেন, নিখিল বিশ্বকে একের দ্বারা পূৰ্ণ করে দেখবে, সেইখানেই বলেছেন, মা গধঃ- লোভ করবে না । কারণ, লোভের দ্বারা একের ধারণা থেকে, একের আনন্দ থেকে, বঞ্চিত হতে হয় । লোভীর হাতে কামনার সেই লণ্ঠন যা কেবল একটি বিশেষ সংকীর্ণ জায়গায় তার সমস্ত আলো সংহত করে ; বাকি সব জায়গার সঙ্গে তার অসামঞ্জস্য গভীর অন্ধকারে ঘনীভূত হয়ে ওঠে । অতএব, লোভের এই সংকীর্ণ ঐক্যের সঙ্গে সৃষ্টির ঐক্যের, রস-সাহিত্য ও ললিতকলার ঐক্যের সম্পূর্ণ তফাত । নিখিলকে ছিন্ন করে হয় লাভ, নিখিলকে এক করে হয় রস। লক্ষপতি টাকার থলি নিয়ে ভেদ ঘোষণা করে ; আর গোলাপ নিখিলের দূত, একের বার্তাটি নিয়ে সে ফুটে ওঠে । যে এক অসীম, গোলাপের হৃদয়টুকু পূৰ্ণ করে সেই তো বিরাজ করে। কীটুস তার কবিতায় নিখিল একের সঙ্গে গ্ৰীকপাত্রটির ঐক্যের কথা জানিয়েছেন । তিনি বলেছেন Thou silent form, dost tease us out of thought, As doth eternity. সংগীতৰ মূর্তি তুমি আমাদের মনকে ব্যাকুল করে সকল চিন্তার বাইরে নিয়ে যাও, যেমন নিয়ে যায় কেননা, অখণ্ড একের মূর্তি যে-আকারেই থাকি-না অসীমকেই প্ৰকাশ করে ; এইজন্যেই সে অনির্বাচনীয়, মন এবং বাক্য তার কিনারা না পেয়ে ফিরে ফিরে আসে । অসীম একের সেই আকুতি যা ঋতুদের ডালায় ডালায় ফুলে ফুলে বারে বারে পূর্ণ হয়েও নিঃশেষিত হল না, সেই সৃষ্টির আকুতিই তো রূপদক্ষের কারুকলার মধ্যে আবির্ভূত হয়ে আমাদের চিত্তকে চিন্তার বাইরে উদাস করে নিয়ে যায়। অসীম একের আকুতিই তো সেই বেদনা যা বেদ বলেছেন, সমস্ত আকাশকে ব্যথিত করে রয়েছে। সে ‘রোদসী’, ‘ক্রান্দসী’ - সে কাদছে। সৃষ্টির কান্না রূপে রূপে, আলোয়, আলোয় আকাশে আকাশে নানা আবর্তনে আবর্তিত- সূর্যে চন্দ্রে, গ্রহে নক্ষত্রে, অণুতে পরমাণুতে, সুখে দুঃখে, জন্মে মরণে। সমস্ত আকাশের সেই কান্না মানুষের অন্তরে এসে বেজেছে । সমস্ত আকাশের সেই কান্নাই একটি সুন্দর জলপাত্রের রেখায় রেখায় নিঃশব্দ হয়ে দেখা দেয়। এই পাত্র দিয়ে অসীম আকাশের অমৃতনিবারের রসধারা ভারতে হবে বলেই শিল্পীর মনে ডাক পড়েছিল ; অব্যক্তের গভীরতা থেকে অনির্বচনীয়ের রসধারা। এতে করে যে-রস মানুষের কাছে এসে পেঁৗছবে সে তো শরীরের তৃষ্ণা মেটাবার জন্যে নয়। শরীরের পিপাসা মেটাবার যে-জল তার জন্যে, ভীড় হােক, গণ্ডুষ হােক, কিছুতেই আসে যায় না। এমন অপরূপ পাত্রের প্রয়ােজন কী ; কী বিচিত্র এর