পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO রবীন্দ্র-রচনাবলী বাতাসের মাধ্য দিয়া দেখাই বাস্তবকে দেখা, উপরের স্বচ্ছ আকাশ হইতে দেখাই বস্তুতন্ত্ৰবিরুদ্ধ । ভারতশাসনে দূরের ইংরেজের হস্তক্ষেপ করাকে ইহারা স্পর্ধিত অপরাধ বলিয়া গণ্য করে। ভারতবাসীকে এই কথাটা মনে রাখিতে হইবে, ইংরেজ বলিয়া যে-একটি মহৎ জাতি আছে প্রকৃতপক্ষে সেই যে ভারতশাসন করিতেছে তাহা নহে ; ভারত-দফতরখানার বহুকালক্ৰমাগত সংস্কারের অ্যাসিডে কঁচা বয়স হইতে জীর্ণ হইয়া যে-একটি আমলা-সম্প্রদায় আমাদের পক্ষে কৃত্রিম মানুষ হইয়া আছে আমরা তাহারই প্ৰজা । যে-মানুষ তার সমস্ত মনপ্রাণহৃদয় লইয়া মানুষ, সে নয়, যে-মানুষ কেবলমাত্র বিশেষ প্রয়োজনের মাপে মানুষ- সেই তো কৃত্রিম মানুষ। ফোটােগ্রাফের ক্যামেরাকে কৃত্রিম চোখ বলিতে পারি। এই ক্যামেরা খুব স্পষ্ট করিয়া দেখে কিন্তু সম্পূর্ণ করিয়া দেখে না, তাহা চলতিকে দেখে না, যাহাকে দেখা যায় না। তাহাকে দেখে না । এইজন্য বলা যায় যে, ক্যামেরা অন্ধ হইয়া দেখে । সজীব চোখের পিছনে সমগ্ৰ মানুষ আছে বলিয়া তাহার দেখা কোনো আংশিক প্রয়োজনের পক্ষে যত অসম্পূর্ণ হােক মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পূর্ণ ব্যবহারক্ষেত্রে তাহাই সম্পূর্ণতর। বিধাতার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ যে তিনি চোখের বদলে আমাদিগকে ক্যামেরা দেন নাই। কিন্তু হায়, ভারতশাসনে তিনি এ কী দিলেন । যে বড়ো-ইংরেজ যোলো-আনা মানুষ, আমাদের ভাগ্যে সে থাকে সমুদ্রের ওপারে, আর এপারে পাড়ি দিতেই প্রয়োজনের কঁাচিকলের মধ্যে আপনার বারো-আনা ছাটিয়া সে এতটুকু ছোটাে হইয়া বাহির হইয়া আসে। সেই এতটুকুর পরিমাণ কেবল সেইটুকু যাতে বাড়তির ভাগ কিছুই নাই, অর্থাৎ মানুষের যেটা স্বাদ গন্ধ লাবণ্য, যেটা তার কমনীয়তা ও নমনীয়তা, জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে যাহা নিজেও বাড়িতে থাকে অন্যকেও বাড়াইতে থাকে সে-সমস্ত কি বাদ পড়িল । এই ছোটােখাটাে ছাটাছোেটা ইংরেজ কোনোমতেই বুঝিতে পারে না। এমন অত্যন্ত দামি ও নিখুঁত ক্যামেরা পাইয়াও সজীব চোখের চাহনির জন্য ভিতরে-ভিতরে আমাদের এত তৃষ্ণা কেন । বোঝে না তার কারণ, কলে ছাট পড়িবার সময় ইহাদের কল্পনাবৃত্তিটা যে বাদ পড়িয়াছে। ইংলন্ডের সরকারি অনাথ-আশ্রমে যারা থাকে তাদের মন কোন পালাই-পালাই এবং প্ৰাণ কেন ত্ৰাহি-ত্ৰাহি করে । কেননা ঐ ওআর্ক-হাউস সম্পূর্ণ ঘরও নয়, সম্পূর্ণ বাহিরও নয়। উহা আত্মীয়তাও দেয় না, মুক্তিও দেয় না। উহা কড়ায় গণ্ডায় হিসাব করিয়া কেবলমাত্র আশ্রয় দেয় । আশ্রয়টা অত্যন্ত দরকারি বটে, কিন্তু মানুষ যেহেতু মানুষ সেইজন্য সে ঘরকে চায়, অর্থাৎ দরকারের সঙ্গে বহুল পরিমাণে অ-দরকারকে না। পাইলে সে বঁাচে না । নহিলে সে অপমানিত হয়, সুবিধা-সুযোগ ফেলিয়াও সে পালাইতে চেষ্টা করে । অনাথ-আশ্রমের কড়া কাৰ্যাধ্যক্ষ এই অকৃতজ্ঞতায় বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয় এবং কেবল তার ক্রোধের দ্বারাই দুঃখকে দমন করিবার জন্য সে দণ্ডধারণ করে। কেননা, এই কাৰ্যাধ্যক্ষ পুরা মানুষ নয়, ইহার পুরা দৃষ্টি নাই, এই ছোটাে মানুষ মনে করে দুর্ভাগা ব্যক্তি কেবলমাত্র আশ্রয়ের শান্তিটুকুর জন্য মুক্তিত্ব অসীম আশায় ব্যাকুল আপনি আত্মাকে চিরদিনের মতোই বণিকের ঘরে বাধা রাখিতে পারে । বড়ো-ইংরেজ অব্যবহিতভাবে ভারতবর্ষকে স্পর্শ করে না- সে মাঝখানে রাখিয়াছে ছোটাে-ইংরেজকে । এইজন্য বড়ো-ইংরেজ আমাদের কাছে সাহিত্য-ইতিহাসের ইংরেজি পুঁথিতে, এবং ভারতবর্ষ বড়ো-ইংরেজের কাছে আপিসের দফতরে এবং জমাখরচের পাকা খাতায়। অর্থাৎ ভারতবর্ষ তার কাছে স্তুপাকার স্ট্যাটিস্টিক্সের সমষ্টি । সেই স্ট্যাটস্টিক্সে দেখা যায় কত আমদানি কত রপ্তানি ; কত আয় কত ব্যয় ; কত জন্মিল কত মরিল ; শান্তিরক্ষার জন্য কত পুলিশ, শাস্তি দিবার জন্য কত জেলখানা। রেলের লাইন কত দীর্ঘ, কলেজের ইমারত কয়তলা উচ্চ । কিন্তু সৃষ্টি তো শুধু নীলাকাশ-জোড়া অঙ্কের তালিকা নয় । সেই অঙ্কমালার চেয়ে অনেক বেশির হিসাবটা ভারত-আপিসের কোনো ডিপার্টমেন্ট দিয়া কোনো মানবজীবের কাছে গিয়া পৌঁছায় না । এ কথা বিশ্বাস করিতে যত বাধাই থােক, তবু আমাদের দেশের লোকের ইহা নিশ্চয় জানিতে হইবে যে, বড়ো-ইংরেজ বলিয়া একটা বড়ো জাতি সত্যই ভূগোলের এক জায়গায় আছে। প্রবলের প্রতি দুর্বল যে অবিচার করে তাহাতে তার দুর্বলতারই পরিচয় হয়- সেই দীনতা হইতে মুক্ত থাকিলেই আমাদের গীেরব । এ কথা শপথ করিয়া বলা যায় যে, এই বড়ো-ইংরেজ সর্বাংশেই মানুষের মতো ।