পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

gjøV \ხტხ2'ა বোধশক্তি ও কর্মশক্তির প্রাণগত যোগ থাকে ; যখন তার পা কাজ করলে হাত তার ফল পায়, হাত কাজ করলে পা তার ফল পায় । কল্পনা করা যাক, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিছাড়া ভুলে দেহের আকৃতিধারী এমন একটা অপদাৰ্থ তৈরি হয়েছে যার প্রত্যেক বিভাগের চার দিকে নিষেধের বেড়া ; যার ডান-চোখে বঁা-চোখে, ডান-হাতে বা হাতে ভাসুর-ভাদ্রবীেয়ের সম্পর্ক ; যার পায়ের শিরার রক্ত বুকের কাছে উঠতে গেলেই দাবড়ানি খেয়ে ফিরে যায় ; যার তর্জনীটা কড়ে-আঙুলের সঙ্গে এক পঙক্তিতে কাজ করতে গেলে প্ৰায়শ্চিত্তের দায়িক হয় ; যার পায়ে তেল-মালিশের দরকার হলে ডান-হাত। হরতাল করে বসে। এই অত্যন্ত নড়বড়ে পদার্থটা অন্য পাড়ার দেহটার মতো সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পায় না । সে-দেখে, অন্য দেহটা জুতো জামা পরে লাঠি ছাতা নিয়ে পথে অপথে বুক ফুলিয়ে বেড়ায় । তখন সে ভাবে যে, ঐ দেহটার মতো জুতো জামা লাঠি ছাতা জুটলেই আমার সব দুঃখ ঘুচিবে । কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ভুলের পরে নিজের ভুল যোগ করে দিয়ে সংশোধন চলে না । জুতো পেলেও তার জুতো খসে পড়বে, ছাতি পেলেও তার ছাতি হাওয়ায় দেবে উড়িয়ে, আর মনের মতো লাঠি যদি সে কোনোমতে জোগাড় করতে পারে অন্য পাড়ার দেহটি সে লাঠি ছিনিয়ে নিয়ে তার নড়বড়ে জীবলীলার প্রহসনটাকে হয়তো ট্র্যাজেডিতে সমাপ্ত করে দিতে পারে । এখানে জুতো জামা ছাতি লাঠির অভাবটাই সমস্যা নয়, প্ৰাণগত ঐক্যের অভাবটাই সমস্যা । কিন্তু বিধাতার উক্ত দেহরূপী বিদ্রুপটি হয়তো বলে থাকে যে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনৈক্যের কথাটা এখন চাপা থাক, আপাতত সবার আগে যদি কোনো গতিকে একটা জামা জোগাড় করে নিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকতে পারি তা হলে সেই জামাটার ঐক্যে অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গের ঐক্য আপনা-আপনি ঘটে উঠবে । আপনিই ঘটবে এ কথা বলা হচ্ছে নিজেকে ফাকি দেওয়া । এই ফাকি সর্বনেশে ; কেননা, নিজকৃত ফাকিকে মানুষ ভালোবাসে, তাকে যাচাই করে দেখতেই প্ৰবৃত্তি হয় না । মনে আছে, আমার বয়স যখন অল্প ছিল তখন দেশে দুই বিরোধী পক্ষের মধ্যে একটা তর্ক প্ৰায় শোনা যেত, আমরা কি নেশন না নেশন নই। কথাটা সম্পূর্ণ বুঝতুম তা বলতে পারি নে, কিন্তু আমরা নেশন নই। এ কথা যে মানুষ বলত রাজা হলে তাকে জেলে দিতুম, সমাজপতি হলে তার ধোবা নাপিত বন্ধ করাতুম। তার প্রতি অহিংস্রভাব রক্ষা করা আমার পক্ষে কঠিন হত । তখন এ সম্বন্ধে একটা বাধা তর্ক এই ছিল যে, সুইজারল্যান্ডে তিন ভিন্ন জাত পাশাপাশি রয়েছে। তবুও তো তারা এক নেশন, তবে আর কী ! শুনে ভাবতুম, যাক, ভয় নেই। কিন্তু মুখে ভয় নেই বললেও আসলে ভয় ঘোচে কই । ফঁাসির আসামীকে তার মোক্তার যখন বলেছিল ‘ভয় কী, দুৰ্গা বলে ঝুলে পড়ো” তখন সে সাত্মনা পায় নি ; কেননা দুৰ্গা বলতে সে রাজি কিন্তু ঐ বুলে পড়াটাতেই আপত্তি । সুইজারল্যান্ডের লোকেরাও । নেশন আর আমরাও নেশন, এ কথা কেবল তর্কে সাব্যস্ত করে সান্তনাটা কী- ফলের বেলায় দেখি, আমরা ঝুলে পড়েছি আর তারা মাটির উপর খাড়া দাড়িয়ে আছে। রাধিক চালুনিতে করে জল এনে কলঙ্কভঞ্জন করেছিলেন । যে হতভাগিনী নারী রাধিকা নয়। তারও চালুনিটা আছে, কিন্তু তার কলঙ্কভঞ্জন হয় না, উলটােই হয় । মূলে যে প্ৰভেদ থাকাতে ফলের এই প্ৰভেদ, সেই কথাটাই ভাববার কথা । সুইজারল্যান্ডের ভেদ যতগুলোই থাক, ভেদবুদ্ধি তো নেই। সেখানে পরস্পরের মধ্যে রক্তবিমিশ্রণে কোনাে বাধা নেই ধর্মে বা আচারে বা সংস্কারে । এখানে সে বাধা এত প্রচণ্ড যে, অসবর্ণ বিবাহের আইনগত বিদ্ম দূর করবার প্রস্তাব হবা মাত্র হিন্দুসমাজপতি উদবেগে ঘর্মািক্ত কলেবর হয়ে হরতাল করবার ভয় দেখিয়েছিলেন । সকলের চেয়ে গভীর আত্মীয়তার ধারা নাড়িতে বয়, মুখের কথায় বয় না । র্যারা নিজেদের এক মহাজাত বলে কল্পনা করেন তাদের মধ্যে সেই নাড়ির মিলনের পথ ধর্মের শাসনে চিরদিনের জন্যে যদি অবরুদ্ধ থাকে, তা হলে তাদের মিলন কখনোই প্ৰাণের মিলন হবে না, সুতরাং সকলে এক হয়ে প্ৰাণ দেওয়া তাদের পক্ষে সহজ হতে পারবে না । তাদের প্রাণ যে এক প্ৰাণ নয় । আমার কোনো বন্ধু ভারতের প্রত্যন্তবিভাগে ছিলেন । সেখানে পাঠান দাসু্যরা মাঝে মাঝে হিন্দু লোকালয়ে চড়াও হয়ে স্ত্রীহরণ করে থাকে । একবার এইরকম ঘটনায় আমার বন্ধু কোনো স্থানীয় হিন্দুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সমাজের উপর এমন অত্যাচার তোমরা সহ্য করো কেন । সে