পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SO 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ঠিক কথা বটে- নিমিখে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি! যতই সময় পাওয়া যায়, ততই কাজ করা যায়। আমাদের হাতে “শতেক যুগ” নাই বলিয়া আমাদের অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থাকে। শতেক যুগ পাইলে আমরা অনেক কাজ সম্পূৰ্ণ করিয়া যাইতে পারি। কিন্তু প্রেমের সময়গণনা যুগ যুগান্তর লইয়া নহে। প্ৰেম নিমিখ লইয়া বাচিয়া থাকে, এই নিমিত্ত প্রেমের সর্বদাই ভয়- পাছে নিমিখ হারাইয়া যায়। এক নিমিখে মাত্র আমি যে একটি চাহনি দেখিয়াছিলাম তাহাই হৃদয়ের মধ্যে লালন করিয়া আমি শতেক যুগ বাচিয়া থাকিতে পারি; আবার হয়তো আমি শতেক যুগ অপেক্ষা করিয়া বসিয়া আছি, কখন আমার একটি নিমেষ আসিবে, একটি মাত্ৰ চাহনি দেখিব ! দৈবাৎ সেই একটি মুহুর্ত হারাইলে আমার অতীত কালের শতেক যুগ ব্যর্থ হইল, আমার ভবিষ্যৎ কালের শতেক যুগা হয়তো নিৰ্ম্মফল হইবে। প্রতিভার স্মৃর্তির ন্যায় প্রেমের স্মৃতিঁও একটি মহেন্দ্ৰক্ষণ একটি শুভ মুহুর্তের উপরে নির্ভর করে। হয়তো শতেক যুগ আমি তোমাকে দেখিয়া আসিতেছি, তবুও তোমাকে ভালোবাসিবার কথা আমার মনেও আসে নাই- কিন্তু দৈবাৎ একটি নিমিখ আসিল, তখন না জানি কোন গ্রহ কোন কক্ষে ছিল— দুই জনে চোখাচৌখি হইল! ভালোবাসিলাম। সেই এক নিমিখ হয়তো পদ্মার তীরের মতো অতীত শত যুগের পাড় ভাঙিয়া দিল ও ভবিষ্যৎ শত যুগের পাড় গড়িয়া দিল। এই নিমিত্তই রাধা। যখন ভাগ্যক্রমে প্রেমের শুভমুহূর্ত পাইয়াছেন তখন তাহার প্রতিক্ষণে ভয় হয় পাছে এক নিমিখ হারাইয়া যায়, পাছে সেই এক নিমিখ হারাইয়া গেলে শতেক যুগ হারাইয়া যায়। পাছে শতেক যুগের সমুদ্রের মধ্যে ডুবিয়া সেই নিমিখের হারানো রত্নটুকু আর খুজিয়া না পাওয়া যায়! সেইজনা তিনি বলিয়াছেন “নিমিখে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি ” এমন যতই উদাহরণ উদ্ধৃত হইবে তােতই প্ৰমাণ হইবে যে, বিদ্যাপতি ও বসন্তরায় এক কবি নহেন, এমন-কি এক শ্রেণীর কবি ও নহেন : বাউলের গান সংগীত সংগ্ৰহ। বাউলের গাথা এমন কোনো কোনো কবির কথা শুনা গিয়াছে, র্যাহারা জীবনের প্রারম্ভ ভাগে পরের অনুকরণ করিয়া কিন্তু সেগুলি শুনিলে মনে হয় যেন তাহা কোনো একটি বাধা রাগিণীর গান, মিষ্ট লাগিতেছে, কিন্তু নূতন ঠেকিতেছে না। অবশেষে এইরূপ লিখিতে লিখিতে, চারি দিক হাতডাইতে হাতড়াইতে, সহসা নিজের যেখানে মর্মস্থান, সেইখানটি আবিষ্কার করিয়া ফেলেন। আর তাহার বিনাশ নাই। এবার তিনি যে গান গাহিলেন তাহা শুনিয়াই আমরা কহিলাম, বাঃ, এ কী শুনিলাম! এ কে গাহিল! এ কী রাগিণী । এত দিন তিনি পরের বাঁশি ধার করিয়া নিজের গান গাহিতেন, তাহাতে তাহার প্রাণের সকল সুর কুলাইত না। তিনি ভাবিয়া পাইতেন না— যাহা বাজাইতে চাহি তাহা বাজে না কেন! সেটা যে বাশির দোষ! ব্যাকুল হইয়া চারি দিকে খুঁজিতে খুঁজিতে সহসা দেখিলেন তাহার প্রাণের মধ্যেই একটা বাদ্য আছে। বাজাইতে গিয়া উল্লাসে নাচিয়া উঠিলেন; কহিলেন, “এ কী হইল। আমার গান পরের গানের মতো শোনায় না কেন ? এত দিন পরে আমার প্রাণের সকল সুরগুলি বাজিয়া উঠিল কী করিয়া ? আমি যে কথা বলিব মনে করি সেই কথাই মুখ দিয়া বাহির হইতেছে!” যে ব্যক্তি নিজের ভাষা আবিষ্কার করিতে পারিয়াছে, যে ব্যক্তি নিজের ভাষায় নিজে কথা কহিতে শিখিয়াছে, তাহার আনন্দের সীমা নাই ; সে কথা কহিয়া কী সুখীই হয়! তাহার এক-একটি কথা তাহার.এক-একটি জীবিত সন্তান। ঘরের কাছে একটি উদাহরণ আছে। বঙ্কিমবাবু যখন দুৰ্গেশনন্দিনী লেখেন তখন তিনি যথার্থ নিজেকে