পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তাই। আমরা তাহার করালমূর্তি দেখিতেছি, কিন্তু তাহার মোহিনীমূর্তি কেহ কেহ বা দেখিয়া থাকিবেন। শিবকে সকলে যোগী বলে। ইনি কাহার যোগে নিমগ্ন রহিয়াছেন ? যোগী হে, কে তুমি হৃদি-আসনে, বিভূতিভূষিত শুভ্ৰদেহ, নচিছ দিক-বসনে! মহা আনন্দে পুলককায়, গঙ্গা উথলি উছলি যায়, ভালে শিশু শশী হাসিয়া চায়, জটাজট ছায় গগনে। সৌন্দর্য ও প্ৰেম সৌন্দর্যের কারণ পূর্বে এক স্থানে বলিয়াছি, যে, যখন জগতের স্বপক্ষে থাকি তখনি আমাদের প্রকৃত সুখ, যখন স্বার্থ খুজিয়া মারি তখনই আমাদের ক্লেশ, শ্রান্তি, অসন্তোষ। ইহা হইতে আর-একটা কথা মনে আসে। যাহাদিগকে আমরা সুন্দর বলি তাহাদিগকে আমাদের কেন ভালো লাগে? পণ্ডিতেরা বলেন, যে সুন্দর তাহার মধ্যে বিষম কিছুই নাই; তাহার। আপনার মধ্যে আপনার পবিপূর্ণ সামঞ্জস্যা; তাহার কোনো- একটি অংশ অপর একটি অংশের সহিত বিবাদ করে না; জেদ করিয়া অনা সকলকে ছাড়াইয়া উঠে না; ঈর্ষাবশত স্বতন্ত্র হইয়া মুখ বাকাইয়া থাকে না। তাহার প্রত্যেক অংশ সমগ্রের সুখে সুখী; তাহারা ভাবে “আমরা যে আপনারা সুন্দর সে কেবল সমগ্রকে সুন্দর করিয়া তুলিবার জন্য' । তাহারা যদি স্ব-স্বপ্রধান হইত, তাহারা যদি সকলেই মনে করিত ‘আর সকলের চেয়ে আমিই মস্ত লোক হইয়া উঠিব, একজন আর একজনকে না মানিত, তাহা হইলে, না তাহারা নিজে সুন্দর হইত, না তাহদের সমগ্রট সুন্দর হইয়া উঠিত। তাহা হইলে একটা বাকাচোরা হ্রস্বদীর্ঘ উচুনীচু বিশৃঙ্খল চক্ষুশূল জন্মগ্রহণ করিত। অতএব দেখা যাইতেছে, যথার্থ যে সুন্দর সে প্রেমের আদর্শ। সে প্রেমের প্রভাবেই সুন্দর হইয়াছে; তাহার আদ্যন্ত মধ্য প্রেমের সূত্রে গাথা; তাহার কোনোখানে বিরোধ বিদ্বেষ নাই। প্রেমের শতদল একটি বৃন্তের উপরে কী মধুর প্রেমে মিলিয়া থাকে! তাই তাহাকে দেখিতে ভালো লাগে। তাহার কোমলতা মধুর; কারণ কোমলতা প্ৰেম, কোমলতা কাহাকেও আঘাত করে না, কোমলতা সকলের গায়ে করুণ হস্তক্ষেপ করে, সে চোখের পাতায় স্নেহ আকর্ষণ করিয়া আনো! ইন্দ্ৰধনুর রঙগুলি প্রেমের রঙ, তাহদের মধ্যে কেমন মিল! তাহারা সকলেই সকলের জন্য জায়গা রাখিয়াছে। কেহ কাহাকেও দূর করিতে চায় না, তাহারা সুরবালিকাদের মতো হাত-ধরাধরি করিয়া দেখা দেয়, গলাগলি করিয়া মিলাইয়া যায়। গানের সুরগুলি প্রেমের সুর, তাহারা সকলে মিলিয়া খেলাইতে থাকে, তাহারা পরস্পরকে সাজাইয়া দেয়, তাহারা আপনার সঙ্গিনীদের দূর হইতে ডাকিয়া আনে! এইজন্যই সৌন্দর্য মনের মধ্যে প্ৰেম জন্মাইয়া দেয়, সে আপনার প্ৰেমে অন্যাকে প্রেমিক করিয়া তুলে, সে আপনি সুন্দর হইয়া অন্যকে সুন্দর করে। সৌন্দর্য বিশ্বপ্ৰেমী যে সুন্দর, কেবল যে তাহার নিজের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে তাহা নয়; সৌন্দর্যের সামঞ্জস্য সমস্ত জগতের সঙ্গে। সৌন্দর্য জগতের অনুকূল। কদৰ্যতা শয়তানের দলভুক্ত। সে বিদ্রোহী ! সে যে টিকিয়া থাকে সে কেবল মাত্র গায়ের জোরে। তাও সে থাকিত না, কারণ কতটুকুই বা তাহার গায়ে জোরকিন্তু প্ৰকৃতি তাহা হইতেও বুঝি সৌন্দৰ্য অভিব্যক্ত করিবেন।