পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br রবীন্দ্ৰ-রচনাবলীܟܠ তাহাই বলিয়া এমন প্রতিজ্ঞা করিয়া বসা ভালো হয় না, যে, যুদ্ধ ছাড়িয়া দিয়া যদি কেহ এপিক লেখে তবে তাঁহাকে এপিক বলিব না! এপিক কাব্য লেখার আরম্ভ হইল কী হইতে ? কবিরা এপিক লেখেন কেন? এখনকার কবিরা যেমন “এসো একটা এপিক লেখা যাক” বলিয়া সরস্বতীর সহিত বন্দোবস্ত করিয়া এপিক লিখিতে বসেন, প্রাচীন কবিদের মধ্যে অবশ্য সে ফেসিয়ান ছিল না। মনের মধ্যে যখন একটা বেগবান অনুভবের উদয় হয়, তখন কবিরা তাহা গীতিকাব্যে প্ৰকাশ না করিয়া থাকিতে পারেন না। তেমনি মনের মধ্যে যখন একটি মহৎ ব্যক্তির উদয় হয়, সহসা যখন তাহাদের মনশ্চক্ষের সম্মুখে অধিষ্ঠিত হয়, তখন তাহারা উন্নতভাবে উদ্দীপ্ত হইয়া সেই পরমপুরুষের প্রতিমা প্ৰতিষ্ঠা করিবার জন্য ভাষার মন্দির নির্মাণ করিতে থাকেন। সে মন্দিরের ভিত্তি পৃথিবীর গভীর অন্তর্দেশে নিবিষ্ট থাকে, সে মন্দিরের চূড়া আকাশের মেঘ ভেদ করিয়া উঠে। সেই মন্দিরের মধ্যে যে প্ৰতিমা প্রতিষ্ঠিত হন তাহার দেবভাবে মুগ্ধ হইয়া, পুণ্যকিরণে অভিভূত হইয়া নানা দিকদেশ হইতে যাত্রীরা তাহাকে প্ৰণাম করিতে আসে। ইহাকেই বলে মহাকাব্য। মহাকাবা পড়িয়া আমরা তাহার রচনাকালের যথার্থ উন্নতি অনুমান করিয়া লইতে পারি। আমরা বুঝিতে পারি। সেই সময়কার উচ্চতম আদর্শ কী ছিল। কাহাকে তখনকার লোকেরা মহত্ত্ব বলিত। আমরা দেখিতেছি হোমরের সময়ে শারীরিক বলকেই বীরত্ব বলিত, শাৰীবিক বলের নামই ছিল মহত্ত্ব। বাহুবলদৃপ্ত একিলিসই ইলিয়ডের নায়ক ও যুদ্ধবৰ্ণনাই তাহার আন্দোপান্ত ; আর আমরা দেখিতেছি বাল্মীকির সময়ে ধর্মবলই যথার্থ মহত্ত্ব বলিয়া গণা ছিল— কেবল মাত্র দাম্ভিক বাহুবলকে তখন ঘূণা করিত। হোমরে দেখো একিলিসের ঔদ্ধত্য. একিলিসের বাহুবল, একিলিসের হিংস্র প্রবৃত্তি; আর রামায়ণে দেখো এক দিকে রামের সত্যের অনুরোধে আত্মত্যাগ, একদিকে লক্ষ্মণের প্রেমের অনুরোধে আত্মত্যাগ, এক দিকে বিভীষণের ন্যায়ের অনুরোধে সংসারতােগা ; রামও যুদ্ধ করিয়াছেন, কিন্তু সেই যুদ্ধঘটনাই তাহার সমস্ত চরিত্র ব্যাপ্ত করিয়া থাকে নাই, তাহা তাহার চরিত্রের সামানা এক অংশ মাত্র । ইহা হইতেই প্ৰমাণ হইতেছে হোমরের সময়ে বলকেই ধর্ম বলিয়া জানিত ও বাল্মীকির সময়ে ধর্মকেই বল বলিয়া জানিত । অতএব দেখা যাইতেছে কবিরা স্ব স্ব সময়ের উচ্চতম আদর্শের কল্পনায় উত্তেজিত হইয়াই মহাকাব্য রচনা করিয়াছেন ও সেই উপলক্ষে ঘটনাক্রমে যুদ্ধের বর্ণনা অবতারিত হইয়াছে — যুদ্ধের বর্ণনা করিবার জন্যই মহাকাব্য লেখেন নাই। কিন্তু আজকাল যাহারা মহাকবি হইতে প্ৰতিজ্ঞা করিয়া মহাকাব্য লেখেন তাহারা যুদ্ধকেই মহাকাব্যের প্রাণ বলিয়া জানিয়াছেন; রাশি রাশি খটমট শব্দ সংগ্ৰহ করিয়া একটা যুদ্ধের আয়োজন করিতে পারিলেই মহাকাব্য লিখিতে প্ৰবৃত্ত হন। পাঠকেরাও সেই যুদ্ধবৰ্ণনামাত্ৰকে মহাকাব্য বলিয়া সমাদর করেন। হয়তো কবি স্বয়ং শুনিলে বিস্মিত হইবেন, এমন আনাডিও অনেক আছে যাহারা হেমবাবুর বৃত্ৰসংহারকে আমরা এইরূপ নাম-মাত্ৰ-মহাকাব্য শ্রেণীতে গণ্য করি না, কিন্তু মাইকেলের মেঘনাদবধকে আমরা তাহার অধিক আর কিছু বলিতে পারি না। মহাকাব্যের সর্বত্রই কিছু আমরা কবিতের বিকাশ প্রত্যাশা করিতে পারি না। কারণ, আট-নয় সগ ধরিয়া, সাত-আটশো পাতা বাপিয়া চরিত্রবিকাশ, চরিত্রমহত্ত্ব দেখিতে চাই ! মেঘনাদবধের অনেক স্থলেই হয়তো কবিত্ব আছে, কিন্তু কবিতাগুলির মেরুদণ্ড কোথায়! কোন অটল আচলকে আশ্রয় করিয়া সেই কবিত্বগুলি দাড়াইয়া আছে! যে-একটি মহান চরিত্র মহাকাব্যের বিস্তীর্ণ রাজ্যের মধ্যস্থলে পর্বতের ন্যায় উচ্চ হইয়া উঠে, যাহার শুভ্র তুষারললাটে সর্যের কিরণ প্ৰতিফলিত হইতে থাকে, যাহার কোথাও বা কবিত্বের শ্যামল কানন, কোথাও বা অনুর্বর বন্ধুর পাষাণাস্তাপ, যাহার অন্তৰ্গঢ় আগ্নেয় আন্দোলনে সমস্ত মহাকাব্যে ভূমিকম্প উপস্থিত হয়, সেই অভ্ৰভেদী বিরাট মূর্তি মেঘনাদবধ কাব্যে কোথায় ? কতকগুলি ঘটনাকে সুসজ্জিত করিয়া ছন্দোবন্ধে উপন্যাস লেখাকে মহাকাব্য কে বলিবে ? মহাকাব্যে মহৎ চরিত্র দেখিতে চাই ও সেই