পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা Գ Տ লোকে বলিবে, “ও কথা তো সকলেই বলে, উহার উলটাটা যদি কোনো প্রকারে প্রমাণ করাইয়া দিতে পার’, তাহা হইলে বড়ো ভালো লাগে।” ভালো তো লাগে, কিন্তু বিষয়টা এমনতর যে তাহাতে একটা বৈ দুইটা কথা উঠিতে পারে না। কবি কথাটা এমন একটা সমস্যা নয় যে তাহাতে বুদ্ধির মারপ্যাচ খেলানো যায়, “বীজ হইতে বৃক্ষ কি বৃক্ষ হইতে বীজ” এমন একটা তর্কের খেলেনা নয়। ভাবপ্রকাশের সুবিধার জন্য লোকসাধারণে একটি বিশেষ পদার্থের একটি বিশেষ নামকরণ করিয়াছে, সেই নামে হইতে পারে? লোকে কাহাকে কবি বলে? যে ব্যক্তি বিশেষ শ্রেণীর ভাবসমূহ (যাহাকে আমরা কবিতা বলি) ভাষায় প্রকাশ করে!* নীরব ও কবি দুটি অন্যোন্যবিরোধী কথা, তথাপি যদি তুমি বিশেষণ নী ববের সহিত বিশেষ্য কবির বিবাহ দিতে চাও, তবে এমন একটি পরস্পরধবংসী দম্পতির সৃষ্টি হয়, যে, শুভদৃষ্টির সময় পরস্পর চোখাচৌখি হইবামাত্ৰেই উভয়ে প্রাণত্যাগ করে। উভয়েই উভয়ের পক্ষে ভস্মলোচনা। এমনতর চোখাচোখিকে কি অশুভদৃষ্টি বলাই সংগত নয়, অতএব এমনতর বিবাহ কি না। দিলেই নয় y এমন হয় বটে, যে, তুমি যাহাকে কবি বলে আমি তাহাকে কবি বলি না; এই যুক্তির উপর নিৰ্ভৰ করিয়া তুমি বলিতে পাের বটে, যে, “যখন বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন লোকে কবি বলিয়া থাকে, তখন কী করিয়া বলা যাইতে পারে যে কবি বুলিতে সকলেই এক অৰ্থ বুঝে ?” আমি বলি কি, একই অর্থ বুঝে! যখন পদাপুণ্ডবীকের গ্রন্থকার শ্ৰীযুক্ত রামবাবুকে তুমি কৰি বলিতেছ, আমি কবি বলিতেছি না ও কবিতাচন্দ্রিকার গ্রন্থকার শ্ৰীযুক্ত শ্যামবাবুকে আমি কবি বলিতেছি। তুমি বলিতেছ না, তখন তোমাতে আমাতে এই তর্ক যে, “রামবাবু কী এমন কবি যে তাঁহাকে কবি বলা যাইতে পারে?” বা, “শ্যামবাবু কী এমন কবি যে তাহাকে কবি বলা যাইতে পারে?” রামবাবু ও শ্যামবাবু এক স্কুলে পড়েন, তবে তাহদের মধ্যে কে ফাস্ট ক্লাসে পড়েন কে লাস্ট ক্লাসে পড়েন তাঁহাই লইয়া কথা। রামবাবু ও শ্যামবাবু যে এক স্কুলে পড়েন, সে স্কুলটি কী? না, প্রকাশ করা। তাহদের মধ্যে সাদৃশ্য কোথায়? না, প্ৰকাশ করা লইয়া। বৈসাদৃশ্য কোথায়? কিরূপে প্ৰকাশ করা হয় তাহা লইয়া। তবে, ভালো কবিতাকেই আমরা কবিতা বলি, কবিতা খারাপ হইলে তাহাকে আমরা মন্দ কবিতা বলি, সুকবিতা হইতে আরো দূরে গেলে তাহাকে আমরা কবিতা না বলিয়া শ্লোক বলিতে পারি, ছড়া বলিতে পারি, যাহা ইচ্ছা। পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জীবকে আমরা মানুষ বলি, তাহার কাছাকাছি যে আসে তাহাকে বনমানুষ বলি, মানুষ হইতে, আরো তফাতে গেলে তাহাকে মানুষও বলি না, বনমানুষও বলি না, তাহাকে বানর বলি, এমন তর্ক কখনো শুনিয়াছ যে Wordsworth শ্রেষ্ঠ কবি না, ভজহরি (যে ব্যক্তি লেখনীর আকার কিরূপ জানে না) শ্রেষ্ঠ কবি ? অতএব এটা দেখিতেছি, কবিতা প্ৰকাশ না করিলে কাহাকেও কবি বলা যায় না। তোমার মতে তো বিশ্ব-সৃদ্ধ লোককে চিত্রকর বলা যাইতে পারে। এমন ব্যক্তি নাই, যাহার মনে অসংখ্য চিত্র অঙ্কিত না রহিয়াছে, তবে কেন মনুষ্যজাতির আর এক নাম রাখ না চিত্রকর ? আমার কথাটি অতি সহজ কথা। আমি বলি যে, যে ভাববিশেষ ভাষায় প্রকাশ হয় নাই তাহা কবিতা নহে ও যে ব্যক্তি ভাববিশেষ ভাষায় প্রকাশ করে না সেও কবি নহে। র্যাহারা ‘নীরব কবি' কথার সৃষ্টি করিয়াছেন তাহারা বিশ্বচরাচরকে কবিতা বলেন। এ-সকল কথা কবিতাতেই শোভা পায়। কিন্তু অলংকারশূন্য গদো অথবা তর্কস্থলে বলিলে কি ভালো শুনায়? একটা নামকে এরূপ নানা অর্থে ব্যবহার করিলে দোষ হয় এই যে, তাহার দুইটা ডানা বাহির হয়, এক স্থানে ধরিয়া রাখা যায় না। ও ক্রমে ক্রমে হাতছাড়া এবং সকল কাজের বাহির হইয়া বুনো হইয়া দাড়ায়, “আয়" বলিয়া ডাকিলেই খাচার মধ্যে আসিয়া বসে না। আমার কথাটা এই যে, আমার মনে আমার প্ৰেয়সীর ছবি আঁকা আছে বলিয়াই আমি কিছু চিত্রকর নই ও ক্ষমতা থাকিলেই আমার প্ৰেয়সীকে আঁকা যাইতে পারিত বলিয়া আমার প্ৰেয়সী একটি চিত্র নহেন।

  • প্ৰবন্ধটির মধ্যে আড়ম্বর করিয়া কবিতা কথাটির একটি দুরূহ সংজ্ঞা নিৰ্ণয় করিতে বসা সাজে না বলিয়া আমরা নিরস্ত হইলাম।