বউ-ঠাকুরানীর হাট । \وم\O C বসন্ত রায় মাথা নিচু করিয়া দিলেন) । ইহা লইয়া যদি তোমার তৃপ্তি হয় তবে লও। ছুরি আনো । এ মাথায় চুল নাই, এ মুখে যৌবনের রূপ নাই। যম নিমন্ত্রণলিপি পঠাইয়াছে, সে সভার উপযোগী সাজসজ্জাও শেষ হইয়াছে। (বসন্ত রায়ের মুখে অতি মৃদু হাস্যরেখা দেখা দিল) । কিন্তু ভাবিয়া দেখো, প্ৰতাপ, বিভা আমাদের দুধের মেয়ে, তার যখন দুটি চক্ষু দিয়া অশ্রু পড়িবে তখন—” বলিতে বলিতে বসন্ত রায় অধীর উচ্ছাসে একেবারে কাদিয়া উঠিলেন, “আমাকে শেষ করিয়া ফেলো প্ৰতাপ । আমার বঁচিয়া সুখ নাই । তাহার চোখে জল দেখিবার আগে আমাকে শেষ করিয়া ফেলো ৷” প্রতাপাদিত্য এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিলেন । যখন বসন্ত রায়ের কথা শেষ হইল। তখন তিনি ধীরে ধীরে উঠিয়া চলিয়া গেলেন । বুঝিলেন কথাটা প্রকাশ হইয়াছে। নীচে গিয়া প্রহরীদের ডাকাইয়া আদেশ করিলেন, রাজপ্ৰসাদসংলগ্ন খাল এখনই যেন বড়ো বড়ো শালকাঠ দিয়া বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় । সেই খালে রামচন্দ্র রায়ের নৌকা আছে। প্রহরীদিগকে বিশেষ করিয়া সাবধান করিয়া দিলেন, আজ রাত্রে অন্তঃপুর হইতে কেহ যেন বাহির হইতে না পারে । একাদশ পরিচ্ছেদ বসন্ত রায় যখন অন্তঃপুরে ফিরিয়া আসিলেন, তাহাকে দেখিয়া বিভা একেবারে কাদিয়া উঠিল । বসন্ত রায় আর আশ্রমসম্বরণ করিতে পারিলেন না, তিনি উদয়াদিতোর হাত ধরিয়া কহিলেন, “দাদা, তুমি ইহার একটা উপায় করিয়া দাও ।” রামচন্দ্র রায় একেবারে অধীরে হইয়া উঠিলেন । তখন উদয়াদিত্য তাহার তরবারি হস্তে লাইলেন, কহিলেন, “এসো, আমার সঙ্গে সঙ্গে এসো ।” সকলে সঙ্গে সঙ্গে চলিল। উদয়াদিত্য কহিলেন, “বিভা, তুই এখানে থাক, তুই আসিস নে ৷” বিভা শুনিল না । রামচন্দ্র রায়ও কহিলেন, “না, বিভা সঙ্গে সঙ্গেই আসুক ।” সেই নিস্তব্ধ রাত্ৰে সকলে পা টিপিয়া চলিতে লাগিল । মনে হইতে লাগিল, বিভীষিকা চারি দিক হইতে তাহার অদৃশ হস্ত প্রসারিত করিতেছে । রামচন্দ্র রায় সম্মুখে পশ্চাতে পার্শ্বে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন । মামার প্রতি মাঝে মাঝে সন্দেহ জন্মিতে লাগিল । অন্তঃপুর অতিক্রম করিয়া বহির্দেশে যাইবার দ্বারে আসিয়া উদয়াদিত্য দেখিলেন দ্বার রুদ্ধ । বিভা ভয়কম্পিত রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, "দাদা, নীচে যাইবার দরজা হয়তো বন্ধ করে নাই সেইখানে চলো ।” সকলে সেই দিকে চলিল । দীর্ঘ অন্ধকার সিড়ি বাহিয়া নীচে চলিতে লাগিল । রামচন্দ্র রায়ের মনে হইল, এ সিঁড়ি দিয়া নামিলে বুঝি আর কেহ উঠে না, বুঝি বাসুকি সাপের গর্তটা এইখানে, পাতালে নামিবার সিঁড়ি এই । সিঁড়ি ফুরাইলে দ্বারের কাছে গিয়া দেখিলেন দ্বার বন্ধ । আবার সকলে ধীরে ধীরে উঠিল । অন্তঃপুর হইতে বাহির হইবার যতগুলি পথ আছে সমস্তই বন্ধ । সকলে মিলিয়া দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া বেড়াইল, প্রত্যেক দ্বারে ফিরিয়া ফিরিয়া দুই-তিন বার করিয়া গেল । সকলগুলিই বন্ধ । যখন বিভা দেখিল, বাহির হইবার কোনো পথই নাই, তখন সে আশ্রষ্ঠ মুছিয়া ফেলিল । স্বামীর হাত ধরিয়া তাহার শয়নকক্ষে লইয়া গেল। দৃঢ়পদে দ্বারের নিকট দাড়াইয়া অকম্পিত স্বরে কহিল, “দেখিব, এ ঘর হইতে তোমাকে কে বাহির করিয়া লইতে পারে । তুমি যেখানে যাইবে, আমি তোমার আগে আগে যাইব, দেখিব আমাকে কে বাধা দেয় ।” উদয়াদিত্য দ্বারের নিকট দাড়াইয়া কহিলেন, “আমাকে বধ না করিয়া কেহ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতে পরিবে না ।” সুরমা কিছু না বলিয়া স্বামীর পার্শ্বে গিয়া দাড়াইল । বৃদ্ধ বসন্ত রায় সকলের আগে আসিয়া দাড়াইলেন । মামা ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন । কিন্তু রামচন্দ্র রায়ের এ বন্দোবস্ত কিছুতেই ভালো লাগিল না । তিনি ভাবিতেছেন, ‘প্রতাপাদিত্য যেরকম লোক দেখিতেছি তিনি কী না করিতে পারেন । বিভা ও উদয়াদিত্য যে মাঝে পড়িয়া কিছু করিতে পরিবেন, এমন ভরসা হয় না । এ বাড়ি হইতে কোনোমতে বাহির হইতে পারিলে র্বাচি ।” কিছুক্ষণ বাদে সুরমা উদয়াদিত্যকে মদুস্বরে কহিল, “আমাদের এখানে দাড়াইয়া থাকিলে যে কোনো ফল হইবে তাহা তো বোধ হয় না, বরং উলটা। পিতা যতই বাধা পাইবেন, ততই তাহার সংকল্প