পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

と(? & রবীন্দ্র-রচনাবলী - আসিবা মাত্র সুরমা তাহার পা দুটি জড়াইয়া বুকে চাপিয়া বুক ফাটিয়া কঁাদিয়া উঠিল। সুরমা এমন করিয়া কখনো কঁদে নাই । তাহার বলিষ্ঠ হৃদয় আজ শতধা হইয়া গিয়াছে। উদয়াদিত্য সুরমার মাথা চাহিয়া আর কি কথা কহিতে পারে ? মুখের দিকে চায় আর কাদিয়া ওঠে । বলিল, “ঐ মুখ আমি দেখিতে পাইব না ? সন্ধ্যা হইবে, তুমি বাতায়নে আসিয়া বসিবে, আমি পাশে নাই ? ঘরে দীপ জ্বালাইয়া দিবে, তুমি ঐ দ্বারের নিকট আসিয়া দাড়াইবে, আর আমি হাসিতে হাসিতে তোমার হাত ধরিয়া আনিব না ? তুমি যখন এখানে, আমি তখন কোথায় ?” সুরমা যে বলিল “কোথায়”, তাহাতে কতখানি নিরাশা, তাহাতে কত দূর-দূরান্তরের বিচ্ছেদের ভাব ! যখন কেবলমাত্র চােখে চােখেই মিলন হইতে পারে তখন মধ্যে কত দূর ! যখন তাহাও হইতে পারে না, তখন আরো কতদূর ! যখন বার্তা লইতে বিলম্ব হয় তখন আরো কতদূর ! যখন প্ৰাণান্তিক ইচ্ছা হইলেও এক মুহূর্তের জন্যও দেখা হইবে না, তখন— তখন ঐ পা দুখানি ধরিয়া এমনি করিয়া বুকে চাপিয়া এই মুহুর্তেই মরিয়া যাওয়াতেই সুখ । সপ্তদশ পরিচ্ছেদ উপাখ্যানের আরম্ভভাগে রুক্সিণীর উল্লেখ করা হইয়াছে, বোধ করি পাঠকেরা তাহাকে বিস্মৃত হন নাই । এই মঙ্গলাই সেই রুক্মিণী । সে রায়গড় পরিত্যাগ করিয়া নাম-পরিবর্তন-পূর্বক যশোহরের প্রান্তদেশে বাস করিতেছে। রুক্সিণীর মধ্যে অসাধারণ কিছুই নাই। সাধারণ নীচ প্রকৃতির স্ত্রীলোকের ন্যায় সে ইন্দ্রিয়পরায়ণ, ঈৰ্ষাপরায়ণ, মনোরাজ্য-অধিকার-লোলুপ । হাসিকান্না তাহার হাত-ধরা, আবশ্যক হইলে বাহির করে, আবশ্যক হইলে তুলিয়া রাখে | যখন সে রাগে তখন সে অতি প্ৰচণ্ডা, মনে হয় যেন রাগের পাত্ৰকে দাতে নখে ছিডিয়া ফেলিবে । তখন অধিক কথা কয় না, চোখ দিয়া আগুন বাহির হইতে থাকে, থারথার করিয়া কঁপে । গলিত লীেহের মতো তাহার হৃদযের কটাহে রাগ টগবগা করিতে থাকে। তাহার মনের মধ্যে ঈর্ষা সাপের মতো ফোস ফোস করে ও ফুলিয়া ফুলিয়া লেজ আছড়াইতে থাকে | এদিকে সে নানাবিধ ব্ৰত করে, নানাবিধ তান্ত্রিক অনুষ্ঠান করে । যে শ্রেণীর লোকদের সহিত সে মেশে, তাহাদের মন সে আশ্চর্যরূপে বুঝিতে পারে । যুবরাজ যখন সিংহাসনে বসিবেন তখন সে যুবরাজের হৃদয়ের উপর সিংহাসন পাতিয়া তাহার হৃদয়রাজ্য ও যশোহর-রাজ্য একত্রে শাসন করিবে, এ আশা শয়নে স্বপ্নে তাহার হৃদয়ে জাগিতেছে । ইহার জন্য সে কী না করিতে পারে । বহুদিন ধরিয়া অনবরত চেষ্টা করিয়া রাজবাটীর সমস্ত দাসদাসীর সহিত সে ভাব করিয়া লইয়াছে। রাজবাটীর প্রত্যেক ক্ষুদ্র খবরটি পর্যন্ত সে রাখে । সুরমার মুখ কবে মলিন হইল তাহাও সে শুনিতে পায়, প্রতাপাদিত্যের সামান্য পীড়া হইলেও তাহার কানে যায়, ভাবে এইবার বুঝি আপদটার মরণ হইবে। প্রতাপাদিত্য ও সুরমার মরণোদেশে সে নানা অনুষ্ঠান করিয়াছে, কিন্তু এখনো তো কিছুই সফল হয় নাই। প্রতিদিন প্ৰাতে উঠিয়া সে মনে করে আজ হয়তো শুনিতে পাইব, প্রতাপাদিত্য অথবা সুরমা বিছানায় পড়িয়া মরিয়া আছে। প্রতিদিন তাহার অধীরতা বাড়িয়া উঠিতেছে। ভাবিতেছে মন্ত্রতন্ত্র চুলায় যাক, একবার হাতের কাছে পাই তো মনের সাধ মিটাই। ভাবিতে ভাবিতে এমন অধর দংশন করিতে থাকে যে, অধর কাটিয়া রক্ত পড়িবার উপক্রম হয় । রুক্সিণী দেখিল যে, প্রতিদিন সুরমার প্রতি রাজার ও রাজমহিষীর বিরাগ বাড়িতেছে। অবশেষে এতদূর পর্যন্ত হইল যে, সুরমাকে রাজবাটী হইতে বিদায় করিয়া দিবার প্রস্তাব হইয়াছে। তাহার আর আনন্দের সীমা নাই । যখন সে দেখিল তবুও সুরমা গেল না, তখন সে বিদায় করিয়া দিবার সহজ উপায় অবলম্বন করিল। রাজমহিষী যখন শুনিলেন, মঙ্গলা-নামক একজন বিধবা তন্ত্র মন্ত্র ঔষধ নানাপ্রকার জানে তখন তিনি ভাবিলেন, সুরমাকে রাজবাটী হইতে বিদায় করিবার আগে যুবরাজের মনটা তাহার কােছ হইতে