পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vb (bor রবীন্দ্র-রচনাবলী রাখিয়াছেন, তাহার উপর আপনার কোনো অধিকার নাই, তাহার উপর অন্য লোক যাহা ইচ্ছা প্ৰভুত্ব করিতে পারে, ইহাতেই কি আপনার মান রক্ষা হইতেছে ?” রাজা কহিলেন, “যদি প্রতাপাদিত্য মেয়েকে না দেয় ?” রামমোহন বিশাল বক্ষ ফুলাইয়া কহিল, “কী বলিলেন মহারাজ ? যদি না দেয় ? এতবড়ো সাধা কাহার যে দিবে না ? আমার মা-জননী, আমাদের ঘরের মা-লক্ষ্মী, কাহার সাধ্য র্তাহাকে আমাদের কাছ হইতে রাখিতে পারে ? যতবড়ো প্রতাপাদিত্য হউন-না কেন, তাহার হাত হইতে কড়িয়া লইব । এই বলিয়া গেলাম। আমার মাকে আমি আনিব, তুমি বারণ করিবার কে ?” বলিয়া রামমোহন প্ৰস্থানের উপক্রম করিলা । রাজা তাড়াতাড়ি কহিলেন, “রামমোহন, যেয়ে না, শোনো শোনো । আচ্ছা, তুমি মহিষীকে আনিতে যাও তাহাতে কোনো আপত্তি নাই, কিন্তু— দেখো, এ কথা যেন কেহ শুনিতে না পায় । রামাই কিংবা মন্ত্রীর কানে যেন এ কথা না উঠে।” রামমোহন কহিল, “ যে আজ্ঞা মহারাজ ।” বলিয়া চলিয়া গেল । যদিও মহিষী রাজপুরে আসিলেই সকলে জানিতে পরিবে, তথাপি সে অনেক বিলম্ব আছে, তাহার জন্য প্ৰস্তুত হইবার সময় আছে । আপাতত উপস্থিত লজার হাত এড়াইতে পারিলেই রামচন্দ্র রায় বাচেন । বিংশ পরিচ্ছেদ উদয়াদিত্য কিসে সুখে থাকেন, দিনরাত বিভার সেই একমাত্র চেষ্টা । নিজের হাতে সে তাহার সমস্ত কাজ করে । সে নিজে তাহার খাবার আনিয়া দেয়, আহারের সময় সম্মুখে বসিয়া থাকে, সামান বিষয়েও ত্রুটি হইতে দেয় না। যখন সন্ধ্যার সময় উদয়াদিত্য তাহার ঘরে আসিয়া বসেন, দুই হাতে চক্ষু আচ্ছাদন করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকেন, বুঝি চোখ দিয়া জল পড়িতে থাকে, তখন বিভা আস্তে আস্তে তাহার পায়ের কাছে আসিয়া বসে— কথা উত্থাপন করিতে চেষ্টা করে, কিছুই কথা যোগায় না। দুইজনে স্তব্ধ, কাহারও মুখে কথা নাই। মলিন দীপের আলো মাঝে মাঝে কঁপিয়া কঁপিয়া উঠিতেছে, সেই সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের উপরে একটা আঁধারের ছায়া কঁাপিতেছে, বিভা অনেকক্ষণ ধরিয়া চুপ করিয়া সেই ছায়ার দিকে চাহিয়া চাহিয়া বুক ফাটিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কঁদিয়া উঠে, “দাদা, সে কোথায় গেল ?” উদয়াদিত্য চমকিয়া উঠেন, চক্ষুর আচ্ছাদন অপসারণ করিয়া বিভার মুখের দিকে চাহিয়া থাকেন, যেন বিভা কী বলিল ভালো বুঝিতে পারেন নাই, যেন তাঁহাই বুঝিতে চেষ্টা করিতেছেন, সহসা চৈতন্য হয়, তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া বিভার কাছে আসিয়া বলেন, “আয় বিভা, একটা গল্প বলি শোন ।” বর্ষার দিন খুব মেঘ করিয়াছে, সমস্ত দিন বুপ ঝুপ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে। দিনটা আঁধার করিয়া রহিয়াছে, বাগানের গাছপালাগুলা স্থিরভাবে দাড়াইয়া ভিজিতেছে । এক-এক বার বাতাস দিতেছে ও ঘরের মধ্যে বৃষ্টির ছাট আসিতেছে। উদয়াদিত্য চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। আকাশে মেঘ ডাকিতেছে, দিগন্তে বিদ্যুৎ হানিতেছে। বৃষ্টির অবিশ্রাম শব্দ কেবল যেন বলিতেছে, “সুরমা নাই— সে নাই ।” মাঝে মাঝে আন্দ্র বাতাস হুহু করিয়া আসিয়া যেন বলিয়া যায়, “সুরমা কোথায় !” বিভা ধীরে ধীরে উদয়াদিত্যের কাছে আসিয়া কহে, “দাদা !” দাদা আর উত্তর দিতে পারেন না, বিভাকে দেখিয়াই তিনি মুখ ঢাকিয়া বাতায়নের উপরে মাথা রাখিয়া পড়েন, মাথার উপরে বৃষ্টি পড়িতে থাকে। এমনি করিয়া দিন চলিয়া যায়, সন্ধ্যা হইয়া আসে, রাত্রি হইতে থাকে। বিভা উদয়াদিত্যের আহারের আয়ােজন করিয়া আবার আসিয়া বলে, “দাদা, খাবার আসিয়াছে, খাও”সে ।” উদয়াদিত্য কোনো উত্তর করেন না। রাত্রি অধিক হইতে লাগিল। বিভা কাদিয়া কহে, “দাদা, উঠ, রাত হইল।” উদয়াদিত্য মুখ তুলিয়া দেখেন, বিভা কাদিতেছে, তাড়াতাড়ি উঠিয়া বিভার চোখ মুছাইয়া খাইতে যান। ভালো করিয়া খান