পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট \ტხrპ উদয়াদিত্য আজ সমস্ত দিন বসন্ত রায়ের সঙ্গে সঙ্গে রহিলেন। সমস্ত দিন টিপ টপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতে লাগিল । বিকালবেলায় বৃষ্টি ধরিয়া গেল, উদয়াদিত্য উঠিলেন । বসন্ত রায় কহিলেন, “দাদা, কোথায় যাস ?” উদয়াদিত্য কহিলেন, “একটু বেড়াইয়া আসি ৷” বসন্ত রায় কহিলেন, “আজি নাই-বা গেলি ।” তুই আমার কাছে থাক ভাই!” উদয়াদিত্য কহিলেন, “আমি অধিক দূর যাইব না। দাদামহাশয়, এখনই ফিরিয়া আসিব ।” বলিয়া বাহির হইয়া গেলেন । প্রাসাদের বহিৰ্দ্ধারে যাইতেই একজন প্রহরী কহিল, “মহারাজ, আপনার সঙ্গে যাইব ?” যুবরাজ কহিলেন, “না, আবশ্যক নাই।” প্রহরী কহিল, “মহারাজের হাতে অস্ত্ৰ নাই!” উদয়াদিত্য প্রাসাদের বাহিরে গেলেন। একটি দীর্ঘ বিস্তৃত মােঠ আছে, সেই মাঠের মধ্যে গিয়া পড়িলেন । একলা বেড়াইতে লাগিলেন । ক্রমে দিনের আলো মিলাইয়া আসিতে লাগিল । মনে কত কী ভাবনা উঠিল। যুবরাজ র্তাহার এই লক্ষ্যহীন উদ্দেশ্যহীন জীবনের কথা ভাবিতে লাগিলেন । ভাবিয়া দেখিলেন, তাহার কিছু স্থির নাই, কোথাও স্থিতি নাই— পরের মুহূর্তেই কী হইবে তাহার ঠিকানা নাই । বয়স অল্প, এখনো জীবনের অনেক অবশিষ্ট আছে । কোথাও ঘরবাড়ি না বাধিয়া কোথাও স্থায়ী আশ্রয় না পাইয়া এই সুদূরবিস্তৃত ভবিষ্যৎ এমন করিয়া কিরূপে কাটিবে ? তাহার পর মনে পড়িল— বিভা ৷ বিভা এখন কোথায় আছে ? এতকাল আমিই তাহার সুখের সূর্য আড়াল করিয়া বসিয়া ছিলাম, এখন কি সে সুখী হইয়াছে ? বিভাকে মনে মনে কত আশীর্বাদ করিলেন । মাঠের মধ্যে রৌদ্রে রাখালদের বসিবার নিমিত্ত অশথ বট খেজুর সুপারি প্রভৃতির এক বন আছেযুবরাজ তাহার মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিলেন। তখন সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। অন্ধকার করিয়াছে। যুবরাজের আজ পলাইবার কথা ছিল— সেই সংকল্প লইয়া তিনি মনে মনে আন্দােলন করিতেছিলেন । বসন্ত রায় যখন শুনিবেন উদয়াদিত্য পলাইয়া গেছেন, তখন র্তাহার কিরূপ অবস্থা হইবে, তখন তিনি হৃদয়ে আঘাত পাইয়া করুণ মুখে কেমন করিয়া বলিবেন, “আঁ্যা, দাদা আমার কাছ হইতে পলাইয়া গেল !” সে ছবি তিনি যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন । এমন সময়ে একজন রমণী কর্কশ কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “এই যে গা, এইখানে তোমাদের যুবরাজ- এইখানে ৷” দুইজন সৈন্য মশাল হাতে করিয়া যুবরাজের কাছে আসিয়া দাড়াইল । দেখিতে দেখিতে আরো অনেকে আসিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ফেলিল। তখন সেই রমণী তাহার কাছে আসিয়া কহিল, “আমাকে চিনিতে পার কি গা । একবার এই দিকে তাকাও ! একবার এই দিকে তাকাও !” যুবরাজ মশালের আলোকে দেখিলেন, রুক্মিণী । সৈন্যগণ রুক্মিণীর ব্যবহার দেখিয়া তাহাকে ধমক দিয়া কহিল, “দূর হী মাগী ৷” সে তাহাতে কৰ্ণপাতও না করিয়া কহিতে লাগিল, “এ-সব কে করিয়াছে ? আমি করিয়াছি। এসব কে করিয়াছে ? আমি করিয়াছি। এ-সব সৈন্যদের এখানে কে আনিয়াছে ? আমি আনিয়াছি। আমি তোমার লাগিয়া এত করিলাম, আর তুমি— ।” যুবরাজ ঘূণায় রুক্মিণীর দিকে পশ্চাৎ ফিরিয়া দীড়াইলেন। সৈন্যগণ রুক্মিণীকে বলপূর্বক ধরিয়া তফাত করিয়া দিল। তখন মুক্তিয়ার খ্যা সম্মুখে খবর ?” S88