পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ Հ@ মধুর দৃশ্য র্তাহার বাল্যকালকে সমেহে ঘিরিয়া থাকিত তাহারা আজ হাসিতেছে, তাহাকে আবার আহবান করিতেছে, কিন্তু তাহার মন বলিতেছে, “আমি যাত্ৰা করিয়া বাহির হইয়াছি, আমি বিদায় লইয়াছি, আমি আর ফিরিব না।" শ্বেত পাষাণের মন্দিরের উপরে সূর্যকিরণ পড়িয়াছে এবং তাহার বাম দিকের ভিত্তিতে বকুলশাখার কম্পিত ছায়া পড়িয়াছে। ছেলেবেলায় এই পাষাণমন্দিরকে যেমন সচেতন বোধ হইত, এই সোপানের মধ্যে একলা বসিয়া যখন খেলা করিতেন তখন এই সোপানগুলির মধ্যে যেমন সঙ্গ পাইতেন, আজ প্ৰভাতের সূর্যকিরণে মন্দিরকে তেমনি সচেতন, তাহার সোপানগুলিকে তেমনি শৈশবের চক্ষে দেখিতে লাগিলেন । মন্দিরের ভিতরে মাকে আজ আবার মা বলিয়া মনে হইতে লাগিল। কিন্তু অভিমানে তাহার হৃদয় পুরিয়া গেল, তাহার দুই চক্ষু ভাসিয়া জল পড়িতে লাগিল । রঘুপতিকে আসিতে দেখিয়া জয়সিংহ চোখের জল মুছিয়া ফেলিলেন । গুরুকে প্ৰণাম করিয়া দাড়াইলেন । রঘুপতি কহিলেন, “আজ পূজার দিন । মায়ের চরণ স্পর্শ করিয়া কী শপথ করিয়াছিলে মনে আছে ?” জয়সিংহ কহিলেন, “আছে।” রঘুপতি । শপথ পালন করিবে তো ? জয়সিংহ । হা । রঘুপতি । দেখিয়ো বৎস, সাবধানে কাজ করিয়ো । বিপদের আশঙ্কা আছে। আমি তোমাকে রক্ষা করিবার জন্যই প্ৰজাদিগকে রাজার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়াছি । জয়সিংহ চুপ করিয়া রঘুপতির মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, কিছুই উত্তর করিলেন না ; রঘুপতি তাহার মাথায় হাত দিয়া বলিলেন, “আমার আশীর্বাদে নির্বিঘ্নে তুমি তোমার কার্য সাধন করিতে এই বলিয়া চলিয়া গেলেন । অপরাহুে একটি ঘরে বসিয়া রাজা ধ্রুবের সহিত খেলা করিতেছেন । ধুবের আদেশমতে একবার মাথার মুকুট খুলিতেছেন একবার পরিতেছেন ; ধ্রুব মহারাজের এই দুৰ্দশা দেখিয়া হাসিয়া অস্থির হইতেছে । রাজা ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “আমি অভ্যাস করিতেছি । তাহার আদেশে এ মুকুট যেমন সহজে পরিতে পারিয়াছি, তাহার আদেশে এ মুকুট যেন তেমনি সহজে খুলিতে পারি। মুকুট পরা শক্ত, কিন্তু মুকুট ত্যাগ করা আরো কঠিন ৷” ধ্ৰুবের মনে সহসা একটা ভাবােদয় হইল— কিয়ৎক্ষণ রাজার মুখের দিকে চাহিয়া মুখে আঙুল দিয়া বলিল, “তুমি আজা।” রাজা শব্দ হইতে 'র অক্ষর একেবারে সমুলে লোপ করিয়া দিয়াও খুবের মনে কিছুমাত্র অনুতাপের উদয় হইল না। রাজার মুখের সামনে রাজাকে আজ বলিয়া সে সম্পূর্ণ আত্মপ্ৰসাদ লাভ করিলা । রাজা ধুবের এই ধৃষ্টতা সহ্য করিতে না পারিয়া বলিলেন, “তুমি আজ ।” ধ্রুব বলিল, “তুমি আজ ।” এ বিষয়ে তর্কের শেষ হইল না । কোনো পক্ষে কোনো প্রমাণ নাই, তর্ক কেবলই গায়ের জোরে । অবশেষে রাজা নিজের মুকুট লইয়া ধুবের মাথায় চড়াইয়া দিলেন। তখন ধুবের আর কথাটি কহিবার জো রহিল না, সম্পূর্ণ হার হইল। ধুবের মুখের আধখানা সেই মুকুটের নীচে ডুবিয়া গেল। মুকুট-সমেত মস্ত মাথা দুলাইয়া ধ্রুব মুকুটহীন রাজার প্রতি আদেশ করিল, “একটা গল্প বলে ।” রাজা বলিলেন, “কী গল্প বলিব ?” ধ্রুব কহিল, “দিদির গল্প বলে ।” গল্পমাত্রকেই ধ্রুব দিদির গল্প বলিয়া জানিত। সে জানিত, দিদি যে-সকল গল্প বলিত তাহা ছাড়া পৃথিবীতে আর গল্প নাই। রাজা তখন মস্ত এক পৌরাণিক গল্প ফাদিয়া বসিলেন। তিনি বলিতে