পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Գ 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী পাইতেন। দুই বন্ধুকে একত্র দেখিলেই তিনি সমস্ত মানবজাতিকে বন্ধুপ্রেমে সহায়বান অনুভব করিতেন। পূর্বে যে পৃথিবীকে মাঝে মাঝে মাতৃহীনা বলিয়া বােধ হইত, সেই পৃথিবীকে আনতনয়ন চিরজাগ্ৰত জননীর কোলে দেখিতে পাইলেন। পৃথিবীর দুঃখশোকদারিদ্র্য বিবাদবিদ্বেষ দেখিলেও তাহার মনে আর নৈরাশ্য জন্মিত না। একটিমাত্র মঙ্গলের চিহ্ন দেখিলেই তাহার আশা সহস্ৰ অমঙ্গল ভেদ করিয়া স্বৰ্গভিমুখে প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিত। আমাদের সকলের জীবনেই কি কোনাে-না-কোনােদিন এমন এক অভূতপূর্ব নূতন প্রেম ও নূতন স্বাধীনতার প্রভাত উদিত হয় নাই। যেদিন সহসা এই হাস্যক্ৰন্দনময় জগৎকে এক সুকোমল নবকুমারের মতো এক অপূর্ব সৌন্দর্য প্রেম ও মঙ্গলের ক্রোড়ে বিকশিত দেখিয়াছি ! যেদিন কেহ আমাদিগকে ক্ষুব্ধ করিতে পারে না, কেতু আমাদিগকে জগতের কোনো সুখ হইতে বঞ্চিত করিতে পারে না, কেহ আমাদিগকে কোনো প্রাচীরের মধ্যে রুদ্ধ করিয়া রাখিতে পারে না ! যেদিন এক অপূর্ব বাঁশি বাজিয়া উঠে, এক অপূর্ব বসন্ত জাগিয়া উঠে, চরাচর চিরযৌবনের আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া যায় ! যেদিন সমস্ত দুঃখ-দারিদ্র্য-বিপদকে কিছুই মনে হয় না ! নূতন স্বাধীনতার আনন্দে প্রসারিত হৃদয় গোবিন্দমাণিক্যের জীবনে সেইদিন উপস্থিত হইয়াছে । দক্ষিণ-চট্টগ্রামের রামু শহর এখনো দশ ক্রোশ দূরে ৷ সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ পূর্বে গোবিন্দমাণিক্য যখন আলমখাল-নামক ক্ষুদ্র গ্রামে গিয়া পৌঁছিলেন, তখন গ্রামপ্রাস্তবতী একটি কুটির হইতে ক্ষীণক? বালকের ক্ৰন্দনধ্বনি শুনিতে পাইলেন । গোবিন্দমাণিক্যের হৃদয় সহসা অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল । তিনি তৎক্ষণাৎ সেই কুটিরে গিয়া উপস্থিত হইলেন ; দেখিলেন, যুবক কুটির স্বামী একটি শীর্ণ বালককে কোলে করিয়া লইয়া ঘরের মধ্যে পায়চারি করিতেছে। বালক থারথার করিয়া কঁাপিতেছে এবং থাকিয়া থাকিয়া ক্ষীণ কণ্ঠে কঁাদিতেছে। কুটির স্বামী তাহাকে বুকের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া ঘুম পাড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। সন্ন্যাসবেশী গোবিন্দমাণিক্যকে দেখিয়া সে শশব্যস্ত হইয়া পড়িল । কাতর স্বরে কহিল, “ঠাকুর, ইহাকে আশীর্বাদ করো ।” বালক একবার কেবল তাহার শীর্ণ মুখ তুলিয়া গো র দিকে চাহিল । তাহার চোখের নীচে কালি পড়িয়াছে— তাহার ক্ষীণ মুখের মধ্যে দুখানি চোখ ছাড়া আর কিছু নাই যেন । একবার গোবন্দিমাণিক্যকে দেখিয়াই দুইখানি পাণ্ডুবৰ্ণ পাতলা ঠোঁট নাড়িয়া ক্ষীণ অব্যক্ত শব্দ করিল। আবার তখনই তাহার পিতার স্কন্ধের উপর মুখ রাখিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল । তাহার পিতা তাহাকে কম্বল-সমেত ভূমিতে রাখিয়া রাজাকে প্ৰণাম করিল এবং রাজার পদধূলি লইয়া ছেলের গায়ে মাথায় দিল । রাজা ছেলেকে তুলিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ ছেলেটির বাপের নাম কী ?” কুটির স্বামী কহিল, “আমি ইহার বাপ, আমার নাম যাদব । ভগবান একে একে আমার সকল-কাটিকে লইয়াছেন, কেবল এইটি এখনো বাকি আছে।” বলিয়া গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল । রাজা কুটির স্বামীকে বলিলেন, “আজ রাত্রে আমি তোমার এখানে অতিথি । আমি কিছুই খাইব না, অতএব আমার জন্য আহারাদির উদযোগ করিতে হইবে না। কেবল এখানে রাত্রিযাপন করিব।” বলিয়া সে রাত্রি সেইখানে রহিলেন । অনুচরগণ গ্রামের এক ধনী কায়স্থের বাড়ি আতিথ্য গ্ৰহণ করিল । ” ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল । নিকটে একটা পানাপুকুর ছিল, তাহার উপর হইতে বাষ্প উঠতে লাগিল । গোয়াল-ঘর হইতে খড় এবং শুষ্ক পত্ৰ জ্বালানোর গুরুভার ধোয়া আকাশে উঠিতে পারিল না, গুড়ি মারিয়া সম্মুখের বিস্তৃত জলামাঠকে আচ্ছন্ন করিয়া ধরিল। আসশেওড়ার বেড়ার কােছ হইতে কর্কশ স্বরে বিবি ডাকিতে লাগিল । বাতাস একেবারে বন্ধ, গাছের পাতাটি নড়িতেছে না । পুকুরের অপর পাড়ে ঘন বঁাশঝাড়ের মধ্য হইতে একটা পাখি থাকিয়া থাকিয়া টিটি করিয়া ডাকিয়া উঠিতেছে। ক্ষীণালোকে গোবিন্দমাণিক্য সেই রুগণ বালকের বিবৰ্ণ শীর্ণ মুখ দেখিতেছেন। তিনি তাহার্কে ভালোরূপে কম্বলে আবৃত করিয়া তাহার শয্যার পার্থে বসিয়া তাহাকে নানাবিধ গল্প শুনাহঁতে