পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳԵrO রবীন্দ্র-রচনাবলী বসিল । যেন মনে করিল, কোথাকার এই ব্যক্তি মলিন হাত বাড়াইয়া তাহাদিগকে এখনই আত্মসাৎ করিতে আসিতেছে ! ফকির গভীর হইয়া কহিলেন, “আচ্ছা, আমরা কিছুকাল তোমার এই দুর্গে বাস করিতে পাৰি। রাজাকে যেন অনুগ্রহ করিলেন । মনে মনে কহিলেন, “আমি কে তাহা যদি জানিতে, তবে এই অনুগ্রহে তোমার আর আনন্দের সীমা থাকিত না ।” তিনটি বালককে রাজা কিছুতেই পোষ মানাইতে পারিলেন না । এবং ফকির নিতান্ত যেন নির্লিপ্ত হইয়া রহিলেন । ফকির গোবিন্দমাণিক্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “শুনিয়াছি তুমি এক কালে রাজা ছিলে, কোথাকার রাজা ?” গোবিন্দমাণিক্য কহিলেন, “ত্রিপুরার ” শুনিয়া বালকেরা তাহাকে অত্যন্ত ছোটাে বিবেচনা করিল। তাহারা কোনো কালে ত্রিপুরার নাম শুনে নাই। কিন্তু ফকির ঈষৎ বিচলিত হইয়া উঠিলেন । আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার রাজত্ব গোল কী করিয়া ?” গোবিন্দমাণিক্য কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন । অবশেষে কহিলেন, “বাংলার নবাব শী সুজা নক্ষত্ররায়ের কোনো কথা বলিলেন না । এই কথা শুনিয়া বালকেরা সকলে চমকিয়া উঠিয়া ফকিরের মুখের দিকে চাহিল । ফকিরের মুখ যেন বিবৰ্ণ হইয়া গেল । তিনি সহসা বলিয়া ফেলিলেন, “এ-সকল বুঝি তোমার ভাইয়ের কাজ ? তোমার ভাই বুঝি তোমাকে রাজ্য হইতে তাড়া করিয়া সন্ন্যাসী করিয়াছে ?” রাজা আশ্চর্য হইয়া গেলেন ; কহিলেন, “তুমি এত সংবাদ কোথায় পাইলে সাহেব ?” পরে মনে করিলেন, “আশ্চর্যের বিষয় কিছুই নাই, কাহারও নিকট হইতে শুনিয়া থাকিবেন ।” ফকির তাড়াতাড়ি কহিলেন, “আমি কিছুই জানি না । আমি কেবল অনুমান করিতেছি ।” রাত্ৰি হইলে সকলে শয়ন করিতে গেলেন । সে রাত্রে ফকিরের আর ঘুম হইল না । জাগিয়া দুঃস্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন এবং প্রত্যেক শব্দে চমকিয়া উঠিলেন । পরদিন ফকির গোবিন্দমাণিক্যকে কহিলেন, “বিশেষ প্রয়োজনবশত এখানে আর থাকা হইল না । আমরা আজ বিদায় হই ।” গোবিন্দমাণিক্য কহিলেন, “বালকেরা পথের কষ্টে শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে, উহাদিগকে আর কিছুকাল বিশ্রাম করিতে দিলে ভালো হয় ।” v বালকেরা কিছু বিরক্ত হইল— তাহাদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠটি ফকিরের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমরা কিছু নিতান্ত শিশু না, যখন আবশ্যক তখন অনায়াসে কষ্ট সহ্য করিতে পারি।” গোবিন্দমাণিক্যের নিকট হইতে তাহারা স্নেহ গ্ৰহণ করিতে প্ৰস্তুত নহে। গোবিন্দমাণিক্য আর কিছু বলিলেন না । ফকির যখন যাত্রার উদযোগ করিতেছেন, এমন সময় দুর্গে আর-একজন অতিথি আগমন করিলেন। র্তাহাকে দেখিয়া রাজা ও ফকির উভয়ে আশ্চর্য হইয়া গেলেন। ফকির কী করিবেন ভাবিয়া পাইলেন না। রাজা তাহার অতিথিকে প্ৰণাম করিলেন । অতিথি আর কেহ নহেন, রঘুপতি । রঘুপতি রাজার প্রণাম গ্ৰহণ করিয়া কহিলেন, “জয় হউক ৷” রাজা কিঞ্চিৎ ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “নক্ষত্রের নিকট হইতে আসিতেছ। ঠাকুর ? বিশেষ কোনো সংবাদ আছে ?” রঘুপতি কহিলেন, “নক্ষত্ররায় ভালো আছেন, তাহার জন্য ভাবিবেন না।” আকাশের দিকে হাত তুলিয়া কহিলেন, “আমাকে জয়সিংহ তোমার কাছে পাঠাইয়া দিয়াছে । সে বঁচিয়া নাই। তাহার ইচ্ছা আমি সাধন করিব নহিলে আমার শান্তি নাই। তোমার কাছে থাকিয়া