পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brS 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আর-একটি আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখেছি যে, বাঙালিরা ইংরেজদের কাছে স্বদেশের লোকেদের ও আচার-ব্যবহারের যত নিন্দে করেন, এমন একজন ভারতদ্বেষী অ্যাংগ্লো-ইন্ডিয়ানও করেন না । তিনি নিজে ইচ্ছা করে কথা পাড়েন ও ভারতবর্ষের নানাপ্রকার কুসংস্কার প্রভৃতি নিয়ে প্ৰাণ খুলে হাস্যপরিহাস করেন। তিনি গল্প করেন যে, আমাদের দেশে বল্লভাচার্যের দল বলে একরকম বৈষ্ণবের দল আছে। তাদের সমস্ত অনুষ্ঠান সবিস্তারে বর্ণনা করতে থাকেন। সভার লোকদের হাসাবার অভিপ্ৰায়ে, নোটিব নাচ-গার্লরা কী রকম করে নাচে অঙ্গভঙ্গি করে তার নকল করেন ও তাই দেখে সকলে হাসলে আনন্দ উপভোগ করেন । তার নিতান্ত ইচ্ছে, তাকে কেউ ভারতবষীয় দলের মধ্যে গণ্য না করে । সাহেব-সাজা বাঙালিদের প্রতি পদে ভয়, পাছে তারা বাঙালি বলে ধরা পড়েন । একজন বাঙালি একবার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর-একজন ভারতবষীয় এসে তাকে হিন্দুস্থানিতে দুই-এক কথা জিজ্ঞাসা করে, তিনি মহা খাপা হয়ে উত্তর না দিয়ে চলে যান। তার ইচ্ছে, তাকে দেখে কেউ মনে না করতে পারে যে, তিনি হিন্দুস্থানি বোঝেন। একজন ইঙ্গবঙ্গ একটি জাতীয় সংগীত রামপ্রসাদী সুরে রচনা করেছেন ; এই গানটার একটু অংশ পূর্ব পত্রে লিখেছি, বাকি আর-একটু মনে পড়েছে, এইজন্য আবার তার উল্লেখ করছি। এ গীত র্যার রচনা, তিনি রামপ্রসাদের মতো শ্যামার উপাসক নন, তিনি গৌরীভক্ত । এইজন্যে গৌরীকে সম্বোধন করে বলছেন— মা, এবার মলে সাহেব হবি ; রাঙা চুলে হ্যাট বসিয়ে, পোড়া নোটিব নাম ঘোচাব । সাদা হাতে হাত দিয়ে মা, বাগানে বেড়াতে যাব (আবার) কালো বদন দেখলে পরে ‘ডার্কি' বলে মুখ ফেরাব । আমি পূর্বেই বিলাতে বাড়িওআলী শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছি। তারা বাড়ির লোকদের আবশ্যকমত সেবা করে । অনেক ভাড়াটে থাকলে তারা চাকরানী রাখে বা অন্য আত্মীয়েরা তাদের সাহায্য করবার জন্যে থাকে। অনেকে সুন্দরী ল্যান্ডলেডি দেখে ঘর ভাড়া করেন । বাড়িতে পদার্পণ করেই ল্যান্ডলেডির যুবতী কন্যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে নেন, দু-তিন দিনের মধ্যে তার একটি আদরের নামকরণ করা হয়, সপ্তাহ অতীত হলে তার নামে হয়তো একটা কবিতা রচনা করে তাকে উপহার দেন । সেদিন ল্যান্ডলেডির মেয়ে তাকে এক পেয়ালা চা এনে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, চায়ে কি চিনি দিতে হবে ? তিনি হেসে বললেন, “না নেলি, তুমি যখন ছুয়ে দিয়েছ, তখন আর চিনি দেবার দরকার দেখছি নে !” আমি জানি, একজন ইঙ্গবঙ্গ তার বাড়ির দাসীদের মেজদিদি সেজদিদি বলে ডাকতেন । আমি একজনকে জানি, তিনি তার মেজদিদি-সেজদিদিবগকে এত মান্য করে চলতেন যে, তার ঘরে বা তার পাশের ঘরে যদি এদের মধ্যে কেউ উপস্থিত থাকত, এবং সে অবস্থায় যদি তার কোনো ইঙ্গবঙ্গ বন্ধু গান বা হাস্যপরিহাস করতেন তা হলে তিনি মহা অপ্রতিভ হয়ে বলে উঠতেন, “আরো চুপ করো, চুপ করো, মিস এমিলি কী মনে করবেন ?” আমার মনে আছে, দেশে থাকতে একবার এক ব্যক্তি বিলেত থেকে ফিরে গেলে পর, আমরা তাকে খাওয়াই । খাবার সময় তিনি নিশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, “এই আমি প্ৰথম খাচ্ছি, যেদিন আমার খাবার টেবিলে কোনো লেডি নেই।” একজন ইঙ্গবঙ্গ একবার তার কতকগুলি বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। খাবার টেবিলে কতকগুলি ল্যান্ডলেডি ও দাসী বসে ছিল, তাদের একজনের ময়লা কাপড় দেখে নিমন্ত্রণকর্তা তাকে কাপড় বদলে আসতে অনুরোধ করেছিলেন । শুনে সে বললে, “যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে ময়লা কাপড়েও ভালোবাসা যায় ।” এইবার ইঙ্গবঙ্গদের একটি গুণের কথা তোমাকে বলছি। এখানে র্যারা আসেন, অনেকেই কবুল করেন না যে তারা বিবাহিত, যেহেতু স্বভাবতই যুবতী কুমারী সমাজে বিবাহিতদের দাম অল্প । অবিবাহিত বলে পরিচয় দিলে এখানকার অবিবাহিতদের সঙ্গে মিশে অনেক যথেচ্ছাচার করা যায়, কিন্তু বিবাহিত বলে জানলে তোমার অবিবাহিত সঙ্গীরা ও-রকম অনিয়ম করতে দেয় না ; সুতরাং অবিবাহিত বলে পরিচয় দিলে অনেক লাভ আছে।