পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brG 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী রকমে সাজানাে, যেন মৃত্যুর একটা খেলাঘর- এর মধ্যে কেমন একটি ছেলেমানুষি আছে, মৃত্যুটাকে যেন যথেষ্ট খাতির করা হচ্ছে না। : গোরস্থানের এক জায়গায় সিঁড়ি দিয়ে একটা মাটির নীচেকার ঘরে নাবা গেল । সেখানে সহস্ৰ সহস্ৰ মড়ার মাথা অতি সুশৃঙ্খলভাবে স্তুপাকারে সাজানাে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই নিশিদিন যে একটা কঙ্কাল চলে বেড়াচ্ছে ঐ মুণ্ডগুলো দেখে তার আকৃতিটা মনে উদয় হল । জীবন এবং সৌন্দর্য এই অসীম জীবলোকের উপর একটা চিত্রিত পর্দা ফেলে রেখেছে— কোনো নিষ্ঠুর দেবতা যদি হঠাৎ একদিন সেই লাবণ্যময় চমর্যবনিকা সমস্ত নরসিংসার থেকে উঠিয়ে ফেলে, তা হলে অকস্মাৎ দেখতে পাওয়া যায় আরক্ত অধরপল্লবের অন্তরালে গোপনে বসে বসে শুষ্ক শ্বেত দন্তপঙক্তি সমস্ত পৃথিবী জুড়ে বিদ্রুপের হাসি হাসছে। পুরোনাে বিষয় ! পুরোনাে কথা ! ঐ নরকপাল অবলম্বন করে নীতিজ্ঞ পণ্ডিতেরা অনেক বিভীষিকা প্রচার করেছেন, কিন্তু অনেকক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখে আমার কিছুই ভয় হল না। শুধু এই মনে হল, সীতাকুণ্ডের বিদীর্ণ জলবিম্ব থেকে যেমন খানিকটা তপ্ত বাষ্প বেরিয়ে যায়, তেমনি পৃথিবীর কত যুগের কত দুশ্চিন্তা দুরাশা অনিদ্রা ও শিরঃপীড়া ঐ মাথার খুলিগুলোর, ঐ গোলাকার অস্থি-বুদবুদগুলোর মধ্যে থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। এবং সেইসঙ্গে এও মনে হল, পৃথিবীতে অনেক ডাক্তার অনেক টাকের ওষুধ আবিষ্কার করে চীৎকার করে মরছে, কিন্তু ঐ লক্ষ লক্ষ কেশহীন মস্তক তৎপ্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন, এবং দন্তমাৰ্জনওআলারা যতই প্রচুর বিজ্ঞাপন প্রচার করছে এই অসংখ্য দন্তশ্রেণী তার কোনো খোজ নিচ্ছে না । যাই হােক আপাতত আমার নিজের কপালফলকটার ভিতরে বাড়ির চিঠির প্রত্যাশা সঞ্চরণ করছে। যদি পাওয়া যায় তা হলে এই খুলিটার মধ্যে খানিকটা খুশির উদয় হবে, আর যদি না পাই তা লুই আহিকােটরের মধ্যে দুখ নামক একটা ব্যাপারের উদ্ভব হবে, ঠিক মনে হবে আমি কৃষ্ট ২৩ অক্টোবর । সুয়েজ খালের মধ্যে দিয়ে চলেছি। জাহাজের গতি অতি মন্থর । উজ্জ্বল উত্তপ্ত দিন। একরকম মধুর আলস্যে পূর্ণ আছি। য়ুরোপের ভাব সম্পূর্ণ কাটল । আমাদের সেই রৌদ্রতপ্ত শ্ৰান্ত দরিদ্র ভারতবর্ষ, আমাদের সেই ধরাপ্ৰান্তবতী পৃথিবীর অপরিচিত নিভৃত নদীকলধ্বনিত ছায়াসুপ্ত বাংলা দেশ, আমার সেই অকৰ্মণ্য গৃহপ্ৰিয় বাল্যকাল, কল্পনাবিষ্ট যৌবন, নিশ্চেষ্ট নিরুদ্যম চিন্তাপ্রিয় জীবনের স্মৃতি এই সূর্যকিরণে, এই তপ্ত বায়ুহিল্লোলে সুদূর মরীচিকার মতো আমার দৃষ্টির সম্মুখে জেগে উঠেছে। ডেকের উপরে গল্পের বই পড়ছিলুম। মাঝে একবার উঠে দেখলুম দু-ধারে ধূসরবর্ণ বালুকাতীর— জলের ধারে ধারে একটু একটু বনঝাউ এবং অর্ধশুষ্ক তৃণ উঠেছে । আমাদের ডান দিকের বালুকারাশির মধ্যে দিয়ে একদল আরব শ্রেণীবদ্ধ উট বোঝাই করে নিয়ে চলেছে। প্রখর সূর্যালোক এবং ধূসর মরুভূমির মধ্যে তাদের নীল কাপড় এবং সাদা পাগড়ি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কেউ বা এক জায়গায় বালুকাগহবরের ছায়ায় পা ছড়িয়ে অলসভাবে শুয়ে আছে, কেউ বা নমাজ পড়ছে, কেউ বা নাসারজজু ধরে অনিচ্ছুক উটকে টানাটানি করছে। সমস্তটা মিলে খররৌদ্র আরব মরুভূমির এক খণ্ড ছবির মতো মনে হল । f ২৪ অক্টোবর । আমাদের জাহাজের মিসেস-কে দেখে একটা নাট্যশালার ভগ্নাবশেষ বলে মনে হয় । সেখানে অভিনয়ও বন্ধ, বাসের পক্ষেও সুবিধা নয়। রমণীটি খুব তীক্ষধার- যৌবনকালে নিঃসন্দেহ সেই তীক্ষতা ছিল উজ্জ্বল। যদিও এখনো এর নাকে মুখে কথা, এবং অচিরজাত বিড়ালশাবকের মতো ক্রীড়াচাতুর্য, তবু কোনো যুবক এর সঙ্গে দুটাে কথা বলবার ছুতো অন্বেষণ করে না, নাচের সময় আহবান করে না, আহারের সময়ে সযত্নে পরিবেশন করে না । তার চঞ্চলতার মধ্যে শ্ৰী নেই, প্রৌঢ়তার সঙ্গে রমণীর মুখে যে একটি স্নেহময় সুগভীর সুপ্ৰসন্ন মাতৃভাব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তাও তার কিছুমাত্ৰ দেখি নে । ২৫ অক্টোবর । আজ সকালবেলা স্নানের ঘর বন্ধ দেখে দরজার সামনে অপেক্ষা করে দাড়িয়ে