পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 離 లట్రరి হরিমোহিনী কহিলেন, “বাবা, আমার ভার বিষম ভার। বিধাতা আমার কপালের উপর কি বোঝা চাপিয়েছেন জানি নে, আমাকে কেউ বইতে পারে না। আমার শ্বশুরবাড়িতেও যখন আমার ভার সইল না তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল । কিন্তু বড়ো অবুঝ মন বাবা— বুক যে খালি হয়ে গেছে, সেইটে ভরাবার জন্তে কেবলই ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমার পোড়া ভাগ্যও যে সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। আর থাক বাবা, আর কারও বাড়িতে গিয়ে কাজ নেই— যিনি বিশ্বের বোঝা ব’ন তারই পাদপদ্মে এবার আমি আশ্রয় গ্রহণ করব— আর আমি পারি নে ৷” । বলিয়া বার বার করিয়া দুই চক্ষু মুছিতে লাগিলেন । বিনয় কহিল, “সে বললে হবে না মালি ! আমার মার সঙ্গে অন্ত কারও তুলনা করলে চলবে না । যিনি নিজের জীবনের সমস্ত ভার ভগবানকে সমর্পণ করতে পেরেছেন, তিনি অন্তের ভার বইতে ক্লেশ বোধ করেন না। যেমন আমার মা—আর যেমন এখানে দেখলেন পরেশবাবু। সে আমি শুনব না—এক বার আমার তীর্থে তোমাকে বেড়িয়ে নিয়ে আসব, তার পরে তোমার তীর্থ আমি দেখতে যাব ।” হরিমোহিনী কহিলেন, "তাদের তা হলে তো এক বার খবর দিয়ে—” বিনয় কহিল, “আমরা গেলেই মা খবর পাবেন— সেইটেই হবে পাকা খবর ।” হরিমোহিনী কছিলেন, “তা হলে কাল সকালে—” বিনয় কহিল, “দরকার কী ? আজ রাত্রেই গেলে হবে ।” সন্ধ্যার সময় স্বচরিতা আসিয়া কহিল, “বিনয়বাবু, মা আপনাকে ডাকতে পাঠালেন । উপাসনার সময় হয়েছে।” বিনয় কহিল, "মাসির সঙ্গে কথা আছে, আজ আমি যেতে পারব না।” আসল কথা, আজ বিনয় বরদাসুন্দরীর উপাসনার নিমন্ত্রণ কোনোমতে স্বীকার করিতে পারিল না। তাহার মনে হইল সমস্তই বিড়ম্বনা । হরিমোহিনী ব্যস্তসমস্ত হইয়া কছিলেন, “বাবা বিনয়, যাও তুমি । আমার সঙ্গে কথাবার্তা সে পরে হবে । তোমাদের কাজকর্ম আগে হয়ে যাক, তার পরে তুমি এসো ।” স্বচরিতা কহিল, "আপনি এলে কিন্তু ভালো হয় ।” বিনয় বুঝিল সে সভাক্ষেত্রে না গেলে এই পরিবারে যে বিপ্লবের স্বত্রপাত হইয়াছে তাহাকে কিছু পরিমাণে আরও অগ্রসর করিয়া দেওয়া হইবে। এইজন্য সে উপাসনা স্থলে গেল, কিন্তু তাহাতেও সম্পূর্ণ ফললাভ হইল না। উপাসনার পর আহার ছিল— বিনয় কহিল, "আজ আমার ক্ষুধা নেই।”