পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(brb" রবীন্দ্র-রচনাবলী কবি বললেন, “এ কথা কি আমিই মানি নে ? আমি কেবল বলতে চাই- সরলতায় বস্তু কম বলে রসরচনায় তার মূল্য কম। এ কথা স্বীকার করা চলবে না, বরঞ্চ উলটাে। ললিতকলার কোনো-একটি রচনায় প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে, তাতে আনন্দ দিচ্ছে কি না। যদি দিচ্ছে হয়, তা হলে তার মধ্যে উপাদানের যতই স্বল্পতা থাকবে ততই তার গৌরব। বিপুল ও প্রয়াসীসাধ্য উপায়ে একজন লোক যে ফল পায়, আর-একজন সংক্ষিপ্ত ও স্বপ্লায়াস উপায়েই সেই ফল পেলে আর্টের পক্ষে সেইটেই ভালো ; বস্তুত আর্টের সৃষ্টিতে উপায় জিনিসটা যতই হালকা ও প্রচ্ছন্ন হবে ততই সৃষ্টির দিক থেকে তার মর্যাদা বাড়বে। এই মূলনীতি যদি মানো তা হলে সকল প্রকার আর্টেই পদে পদে সতর্ক হয়ে বলতে হবে ; অলমতি বিস্তরেণ। বলতে হবে আর্টে প্ৰগলভ্যতার চেয়ে মিতভাষা, বাহুল্যের চেয়ে সারল্য শ্রেষ্ঠ। আর্টে complex structure অর্থাৎ বন্ধগ্রস্থিল কলেবারের দৃষ্টান্ত-স্বরূপে তাজমহলের উল্লেখ করেছ। আমি তো তাজমহলকে সহজ রূপেরই দৃষ্টান্ত বলে গণ্য করি। একবিন্দু অশ্রািজল যেমন সহজ। তাজমহল তেমনি সহজ। তাজমহলের প্রধান লক্ষণ তার পরিমিতি— ওতে এক টুকরো পাথরও নেই যাতে মনে হতে পারে হঠাৎ তাজমহল কানে হাত দিয়ে তান লাগাতে শুরু করেছে। তাজমহলে তান নেই ; আছে মান, অর্থাৎ পরিমাণ। সেই পরিমাণের জোরেই সে এত সুন্দর। পরিমাণ বলতেই বোঝায় উপাদানের সংযম । আমের সঙ্গে। কঁঠালের তুলনা করে দেখো-না। কঁঠালের উপরকার আবরণ থেকে ভিতরকার উপকরণ পর্যন্ত সমস্তটার মধ্যেই আতিশয্যা ; সবটা মিলে একটা বোঝা। যেন একটা বস্তা। বাহাদুরির দিক থেকে দেখলে বাহবা দিতেই হবে। কঁঠালের শস্যঘটিত তানবাহুল্যে মিষ্টতা নেই। তাও বলতে পারি নে- নেই সৌষ্ঠব, কলারচনায় যে জিনিসটি অত্যাবশ্যক। কঁঠালকে আমের মতো সাদাসিধে বলে না ; তার কারণ এ নয় যে, কঁঠাল প্ৰকাণ্ড এবং ওজনে ভারী। যার অংশগুলির মধ্যে সুগঠিত ঐক্য, সেই হচ্ছে সিম্পল। যদি নতুন কথা বানাতে হয় তা হলে সেই জিনিসকে বলা যেতে পারে সংকল, অর্থাৎ তার সমস্ত কলাগুলি সুসংগত। আমাদের শাস্তুে ব্ৰহ্মকে বলে নিষ্কল, তার মধ্যে অংশ নেই, তিনিই হচ্ছেন অসীম সিম্পল – অথচ তীর মধ্যে সমস্তই আছে, সমস্তকে নিয়ে তিনি অখণ্ড। সূর্যের যে রশ্মিকে আমরা সাদা বলি তার মধ্যে বর্ণরশ্মির বিরলতা আছে তা নয়, তার মধ্যে সকল রশ্মির ঐক্য। তাজমহলও তেমনি সাদা, তার মধ্যে সমস্ত উপকরণের সুসংঘটিত সামঞ্জস্য। এই সামঞ্জস্যের সুষমাকে যদি আমরা ছিন্ন করে দেখি তবে তার মধ্যে বৈচিত্র্যের অন্ত দেখব না। রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে দেখলে একটি অশ্রুবিন্দুতেও আমরা বহুকে দেখতে পাই, কিন্তু যে দেখাটিকে আশ্রম বলি সে নিতান্ত সাদা, সে এক। সেখানে সৃষ্টিকর্তা তীর ঐশ্বর্যের আড়ম্বর করতে চান নি, সরলভাবে তীর রূপদক্ষতা দেখিয়েছেন। তঁর অশ্রািজলে রিক্ততা আছে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক যখন সেই অশ্রািজলের হিসাবের খাতা বের করে দেখান তখন ধরা পড়ে রিক্ততার পিছনে কতখানি শক্তি। তখন বুঝতে পারি অতিরিক্ততাই সৃষ্টিশক্তির অভাব প্রকাশ করে, আর যারা অতিরিক্ত না হলে দেখতে পায় না। তাদের মধ্যে দৃষ্টিশক্তিই দীনতা।” কবির এ কথাটি আমার খুবই ভালো লাগল। তবে আমার সাফাই এই যে, সারল্যের মধ্যেকার এই গরিমার সম্বন্ধে আমি নিজেকে একটু সচেতন বলেই মনে করি। আবু পাহাড়ের দিলওয়ারা মন্দিরের কারুকার্য-বাহুল্যের বিরুদ্ধ সমালোচনায় এ কথা আমি লিখেছি (অর্থাৎ ললিতকলায় সারল্যের স্থান কোথায় সে সম্বন্ধে মতামত প্রকাশের সময়)- ওস্তাদি গানের সম্পর্কে তো কথাই নেই। কেবল আমার এ অবধি মনে হয়েছে যে, শ্রেষ্ঠ শ্রেণীর complexity-র আবেদন