পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী 62 (6و পারসপেকটিভের মধ্যে দাঁড় করায় যেখানে ওর ক্ষুদ্র ক্ষণস্থায়ী অসামঞ্জস্যগুলো আর চোখে পড়ে না- একটা সমগ্র একটা বৃহৎ একটা নিত্য সামঞ্জস্য-দ্বারা সমস্ত পৃথিবী ছবির মতো হয়ে আসে এবং মানুষের জন্ম-মৃত্যু হাসি-কান্না ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের পর্যায় একটি কবিতার সকরুণ ছন্দের মতো কানে বাজে। সেইসঙ্গে আমাদেরও নিজ নিজ ব্যক্তিগত প্রবলতা তীব্রতার হ্রাস হয়ে আমরা অনেকটা লঘু হয়ে যাই এবং একটি সংগীতময়ী বিস্ত্রীর্ণতার মধ্যে অতি সহজে আত্মবিসর্জন করে দিই। ক্ষুদ্র এবং কৃত্রিম সমাজ-বন্ধনগুলি সমাজের পক্ষে বিশেষ উপযোগী, অথচ সংগীত এবং উচ্চ অঙ্গের আর্ট মাত্রেই সেইগুলির অকিঞ্চিৎকরতা মুহূর্তের মধ্যে উপলব্ধি করিয়ে দেয়— সেইজন্যে আর্ট মাত্রেরই ভিতর খানিকটা সমাজনাশকতা আছে- সেইজন্যে ভালো গান কিংবা কবিতা শুনলে আমাদের মধ্যে একটা চিত্তচাঞ্চল্য জন্মে, সমাজের লৌকিকতার বন্ধন ছেদন করে নিত্য-সৌন্দর্যের স্বাধীনতার জন্যে মনের ভিতরে একটা নিৰ্ম্মফল সংগ্রামের সৃষ্টি হতে থাকেসৌন্দৰ্যমাত্রেই আমাদের মনে অনিত্যের সঙ্গে নিতোর একটা বিরোধ বাধিয়ে দিয়ে অকারণ বেদনার সৃষ্টি করে। সাজাদপুর : ৫ জুলাই ১৮৯৫ কাল অনেক রাত পর্যন্ত নহবতে কীর্তনের সুর বাজিয়েছিল ; সে বড়ো চমৎকার লাগছিল, আর ঠিক এই পাড়াগায়ের উপযুক্ত হয়েছিল— যেমন সাদাসিধে তেমনি সকরুণ।... সেকালের রাজাদের বৈতালিক ছিল- তারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে গান গেয়ে প্রহরী জানিয়ে দিত, এই নবাবিটা আমার লোভনীয় মনে হয়। শিলাইদহ। ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৫ সংগীতের মতো এমন আশ্চর্য ইন্দ্ৰজালবিদ্যা জগতে আর কিছুই নেই- এ এক নূতন সৃষ্টিকর্তা। আমি তো ভেবে পাই নে- সংগীত একটা নতুন মায়াজগৎ সৃষ্টি করে না। এই পুরাতন জগতের অন্তরতম অপরূপ নিত্যরাজ্য উদঘাটিত করে দেয়। গান প্রভৃতি কতকগুলি জিনিস আছে যা মানুষকে এই কথা বলে যে, “তোমরা জগতের সকল জিনিসকে যতই পরিষ্কার বুদ্ধিগম্য করতে চেষ্টা করো-না কেন এর আসল জিনিসটাই অনির্বাচনীয়’ এবং তারই সঙ্গে আমাদের মর্মের মর্মান্তিক যোগ- তারই জন্যে আমাদের এত দুঃখ, এত সুখ, এত ব্যাকুলতা। '. . भिक्लनिश्। २७ मtobध में ९४२१ প্রকৃতির সঙ্গে গানের যত নিকট সম্পর্ক এমন আর কিছু না— আমি নিশ্চয় জানি এখনি যদি আমি জানলার বাইরে দৃষ্টি রেখে রামকেলি ভাজতে আরম্ভ করি তা হলে এই রৌদ্ররঞ্জিত সুদূরবিস্তুত শ্যামলনীল প্রকৃতি মন্ত্ৰমুগ্ধ হরিণীর মতো আমার মর্মের কাছে এসে আমাকে অবলেহন করতে থাকবে। যতবার পদ্মার উপর বর্ষা হয় ততবারই মনে করি মেঘমাল্লারে একটা নতুন বর্ষার গান রচনা করি... কথা তো ঐ একই-বৃষ্টি পড়ছে, মেঘ করেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিন্তু তার ভিতরকার নিত্যনূতন আবেগ, অনাদি অনন্ত বিরহবেদনা, সেটা কেবল গানের সুরে খানিকটা প্ৰকাশ পায়।