পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/১৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শরৎ-সাহিত্য-সংগ্রহ

বনমালী মেয়ের মুখের পানে চোখ তুলিয়া কহিয়াছিলেন, ঋণ ত কম নয় মা। ছেলেমানুষ, ও যদি না শুধতে পারে?

মেয়ে জবাব দিয়াছিল, যে না পারে, সে কুসন্তান বাবা, তাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।

বনমালী তাঁহার এই সুশিক্ষিতা তেজস্বিনী কন্যাকে চিনিতেন। তাই আর পীড়াপীড়ি করেন নাই, শুধু একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়াছিলেন, সমস্ত কাজ কর্ম্মে ভগবানকে মাথার উপর রেখে যা কর্ত্তব্য, তাই ক’রো মা? তোমাকে বিশেষ কোন অনুরোধ ক’রে আমি আবদ্ধ ক’রে যেতে চাই নে। বলিয়া ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া পুনরায় একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিয়াছিলেন, জানিস্ মা বিজয়া, জগদীশ যখন একটা মানুষের মত মানুষ ছিল; তখন তুই না জন্মাতেই তোকে তার এই ছেলেটির নাম ক’রেই চেয়ে নিয়েছিল। আমিও মা, কথা দিয়েছিলাম; বলিয়া তিনি যেন উৎসুক দৃষ্টিতেই চাহিয়াছিলেন।

তাঁহার এই কন্যাটি শিশুকালেই মাতৃহীন হইয়াছিল বলিয়া তিনিই তাহার পিতামাতা উভয়ের স্থান পূর্ণ করিয়াছিলেন। তাই বিজয়া পিতার কাছে মায়ের আবদার করিতেও কোন দিন সঙ্কোচ বোধ করে নাই; কহিয়াছিল, বাবা, তুমি তাঁকে শুধু মুখের কথাই দিয়েছিলে, তোমার মনের কথা দাওনি।

কেন মা?

তা দিলে কি একবার তাঁকে চোখের দেখা দেখ্‌তেও চাইতে না?

বনমালী বলিয়াছিলেন, রাসবিহারীর কাছে যখন শুনেছিলাম, ছেলেটি নাকি তার মায়ের মতই দুর্ব্বল—এমন কি, ডাক্তারেরা তার দীর্ঘজীবনের কোন আশাই করেন না, তখন তাকে কাছে পেয়েও একবার আনিয়ে দেখতে চাইনি। এই কলকাতা শহরেই কোন একটা বাসায় থেকে সে তখন বি. এ. পড়ত। তার পরে নিজের নানান অসুখে-বিসুখে সে কথা আর ভাবিনি। কিন্তু এখন দেখছি, সেইটাই আমার মস্ত ক্ষতি হয়ে গেছে মা। তবু, তোকে সত্য বল্‌ছি বিজয়া, সে সময় জগদীশকে তোর সম্বন্ধে আমার মনের কথাই দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ থামিয়া বলিয়াছিলেন, আজ জগদীশকে সবাই জানে—একটা অকর্ম্মণ্য জুয়াড়ি, অপদার্থ মাতাল। কিন্তু এই জগদীশই একদিন আমাদের সকলের চেয়েই ভাল ছেলে ছিল। বিদ্যা-বুদ্ধির জন্য বলছি না মা, সে অনেকেরই থাকে; কিন্তু এমন প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে আমি কাউকে দেখিনি; এই ভালবাসাই তার কাল হয়েছে। তার অনেক দোষ আমি জানি, কিন্তু যখনি মনে পড়ে, স্ত্রীর মৃত্যুতে সে শোকে পাগল হয়ে গেছে, তখন তোর মায়ের কথা স্মরণ ক’রে আমি ত মা,

১৮২