পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৪৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪২ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত চতুর্থ ভাগ বাদশাহ সাক্ষাত বঞ্চিতের বয়স পঞ্চদশ বৎসর মাত্র, এই সময় দিল্লীর বাদশাহ দেশের সাধু সমন্তের সং গ্রহণের অভিলাস করিয়া, কৰ্ম্মচারি বর্গের উপর তালিকা প্রস্তুতের আদেশ দেন। তদনুসারে শ্রীহট্টের শাসন কৰ্ত্তা বা আমিল, শ্রীহট্টের শ্রেষ্ঠ সাধু সমুহের মহিমা, নামাবলী জ্ঞাপন করিলে, তাহাদের কয়েক জনকে দিল্লী লইয়া যাইতে তিনি আদিষ্ট হন। এই আমিলের জন্মভূমি দিল্লী छ्लि । তৎকালে শ্রীহট্টে পাগল শঙ্কর, ঠাকুর রাণী, বৈষ্ণব রায় এবং বঞ্চিত ঘোষ মহিমাই বিশেষ রূপে প্রকাশিত হইয়াছিল। সুতরাং আমিল ইহাদিগকে লইয়া দিল্লী যাত্রা করেন। শ্রীহট্টের সীমা অতিক্রম করিলেই একদিন বঞ্চিত ঘোষ ব্যতীত আর তিন জন আমিলকে বঞ্চিত করিয়া অদৃশ্য হন, তখন আমিল অগত্যা এই মহাত্মাকে লইয়া দিল্লী গমন পূৰ্ব্বক তাহাকেই সম্রাট সদনে উপস্থিত করেন। বাদশাহ সাধুর "কেরামত” বা গুণপনা দর্শনে ইচ্ছা করিলেন, কিন্তু যাহারা “ভবের বাদশাহের” হুকুমে চলিয়া থাকেন, তাহারা কোনও ব্যক্তি বিশেষে ইচ্ছা পূরণের জন্য “ইন্দ্রজাল” জারি করিতে রাজি হন না, বঞ্চিতও হইলেন না। বঞ্চিতের ব্যবহারে বাদশাহ বিরক্ত হইলেন, এবং অখাদ্য খাওয়াইয়া তাহার জাতি নষ্ট করিতে আদেশ দিলেন। দৈব বশতঃ সেই সময় দিল্লী নগরে ভীষণ অগ্নিকাণ্ড উপস্থিত হইল, নাগরিকের হাহাকার ধ্বনি সম্রাটের কর্ণগোচর হইতে লাগিল। সম্রাট নিজ মনে ইহা সাধু নিগ্রহের ঈশ্বর দত্ত শাস্তি বলিয়া বোধ করিলেন ও সেই অসৎ চিন্তায় বিরত হইলেন। সম্রাট ভাবিলেন—যে ব্যক্তি দিল্লীর বাদশাহের সম্মুখে বসিয়া বাদশাহের অনুরোধ উপেক্ষা করিতে পারে, তাহার সেই সাহস হইতে অদ্ভুত আর কি হইতে পারে? কোন "কেরামত" হইতে ইহা ছোট? এই ভাব মনে উদয় হইলে তিনি পূৰ্ব্ব কল্পিত সাধু দ্রোহের কথা স্মরণে লজ্জিত হইলেন ও তজ্জন্য সাধুকে বহুধন ও ভূমি দানের অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। কিন্তু সাধুর কি অভাব? তিনি এ দান গ্রহণ করিলেন না, বলিলেনঃ– বাদশাহ! “কামিনী আর কাঞ্চন দুই অনর্থের মূল । তাতে লোভ কৈলে হর ধৰ্ম্ম নিরমূল।”—বঞ্চিত চরিত্র গ্রন্থ। বাদশাহ হিন্দু সাধুর নির্লোভ ভাব অবলোকনে প্রীত হইলেন; সাধুও সম্রাট সকাশে বিদায় লইয়া বৃন্দাবনে চলিলেন। বৃন্দাবনে পথিমধ্যে এক পৰ্ব্বত, পৰ্ব্বত পার হওয়াকালে মধ্য পথে এক প্রকাণ্ড অজগর তাহাকে আক্রমণ করে, সাধু প্রসন্ন চিত্তে সেই সপকে হরিনাম শুনাইয়া দিলেন, আর সাপ সেই নাম মন্ত্র শ্রবণে উন্নত মস্তক অধঃ করিয়া যেন তাহার চরণে প্রণত হইয়া পড়িল। কথিত আছে, একটা বিদেহী দানব তাহার সম্মুখে পতিত হইয়াছিল, সেও হরিনাম শ্রবণে সরিয়া যায়। তিনি বৃন্দাবনে পৌছিলেন ও শ্রীবিগ্রহ দর্শনে প্রেমে পুলকিত হইলেন। গৌর-পরিকর গোস্বামীগণের সমাধি দর্শনে তিনি ক্ৰন্দন করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি শোকাকুল চিত্তে শয়ন করিয়া নিদ্রা-বিভূত হইলেন, সেই সময় শ্রীজীব গোস্বামী তাহাকে দর্শন দান করিলেন। তিনি শ্রীজীবের চরণে পতিত হইলে, গোস্বামী বলিলেন—যাও বঞ্চিত, দেশে যাও, নিজের সুখের জন্য বৃন্দাবনে বসিয়া রহিও না; অসংখ্য দেশবাসী যে কৃষ্ণ প্রেম সুখে বঞ্চিত রহিয়াছে, কে তাহাদিগকে সুধায় আস্বাদন করাইবে? যাও বঞ্চিত, দেশে যাও, তুমি দেশে গিয়া বিবাহ কর ও সংসারে অলিপ্ত থাকিয়া ধৰ্ম্ম পালনে লোক উদ্ধারের পন্থা প্রদর্শন কর।”