পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৪৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জীবন বৃত্তান্ত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ৫৩ গৌরী চরণ মোনশী একজন সমাজ তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, কঠিন সামাজিক প্রশ্ন সকল সহজে মীমাংসা করিয়া দিতেন, এজন্য নানা স্থান হইতে বিবাহ মীমাংসার জন্য তাহার কাছে লোক আসিত, সেই আগন্তুক বর্গ তাহার আদর আপ্যায়নে ও পরামর্শ প্রাপ্তে তুষ্ট হইয়া প্রত্যাগমন করিত। বিবাহের সপ্ত প্রদক্ষিণ কালে কন্যাকে বহন করিয়া প্রদক্ষিণ করাইবার প্রতি তাহার মনোগত ছিল না, তজ্জন্য তিনি আপন মধ্যম পুত্রের বিবাহ কালে কন্যাকে হটাইয়া সপ্ত প্রদক্ষিণ করাইয়া ছিলেন। তৎকালে যদিও ইহা বিসদৃশ বলিয়া অনেক বোধ করিয়াছিল, কিন্তু পরে শ্রীহট্টের সাহু সমজে ইহা ক্রমশঃ গৃহীত হয়; ইদানীং সকলেই ইহার আবশ্যকতা অনুভব করিতেছেন এবং এই প্রথা সৰ্ব্বত্রই প্রবৰ্ত্তিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে। মোনশী গৌরীচরণ পরম জ্ঞানী ও বিষ্ণু ভক্তি পরায়ণ ছিলেন। ঢাকার অন্তর্গত উথলীর স্বগীয় বৃন্দাবন চন্দ্র গোস্বামী প্রায়শঃ লাতু আসিয়া তৎসহ সম্মিলিত হইতেন। একদা শ্রীহট্টের তখন লাতুতে গিয়া গৌরীচরণের সহিত আলাপ করিলেই শান্তি পাই।” বৈষ্ণব সাধক গোস্বামী মহাশয়ের স্থান অতি উচ্চে, সুতরাং তাহার এই বাক্যে গৌরীচরণের সমাজ ধৰ্ম্ম তৎপরতা ও জ্ঞান গৌরবের পরিমাণ অনুমান করা যাইতে পারে। বেকি টেকার সাধক হরনাথ চক্রবত্তী এবং রফি নগরের সিদ্ধ ফকির শাহ ভৌলা প্রায়ই তাহার সহিত দেখা করিতে আসিতেন । ভোলা বলিতেন—“লাতুতে এক ধুনী ও তিন চেরাগ জুলিতেছে।” ধুনী অর্থাৎ জ্বলন্ত অগ্নি স্বরূপ মোনশী গৌরীচরণ আর তিন চেরাগ অর্থাৎ প্রদীপ স্বরূপ তাহার পুত্র ত্রয়কে উদ্দেশ্য করিয়াই ইহা বলা হইত। তাহার পুত্রত্ৰয়ের নাম চৈতন্য চরণ, বৈষ্ণব চরণ ও গুরুচরণ। চৈতন্য চরণ নসিরাবাদের মুন্সেফ ছিলেন, মধ্যম বৈষ্ণব চরণ ঢাকায় সব জজ হইয়াছিলেন এবং কনিষ্ঠ গুরুচরণ জুনিয়ার স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া আইন অধ্যয়ন পূৰ্ব্বক কৃষ্ণ নগরে অনেক দিন মুন্সেফ পদে ছিলেন, পরে অফিসিয়েটিং সব জজ নিযুক্ত হইয়া ৩৯ বৎসর বয়সে ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে মৃত্যু মুখে পতিত হন। জন্মান্তরীণ কোন কৰ্ম্ম ফলে বলা যায় না, মোনশী গৌরীচরণের এই তিন চেরাগ অকালে নিৰ্ব্বাপিত হইয়া যায়, কিন্তু দারুণ পুত্ৰশোকে এই গম্ভীরাশয় মহাত্মাকে বিচলিত করিতে সামর্থ হয় নাই। তিনি যে কিরূপ উচ্চহৃদয় ও মানসিক শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন, এই সময় তাহা বুঝা গিয়াছিল; তিনি দৈনিক লক্ষ হরিনাম জপ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, নাম জপেই প্রায় সারাদিন কাটাইয়া দিতেন; পুত্ৰশোকে তাহাকে অবসন্ন করিতে অবসর পাইত না। তিনি যদিও হাস্য রসিক পুরুষ ছিলেন8৮, এবং রহস্যাত্মক ও কুটার্থ বোধক বাক্য বলিতে ভাল বাসিতেন, কিন্তু এই সময় হইতে তাহা ত্যাগ করিয়াছিলেন, বৈষয়িক পরামর্শ বা উপদেশ প্রার্থী, অথবা আত্মীয় স্বজন কাহারই সহিত পূৰ্ব্বরূপ আলাপ করিতেন না, সৰ্ব্বদা জপ মালা হাতে নিৰ্জ্জনে বসিয়া থাকিতেন। ফলতঃ এই সময় হইতে তিনি সাংসারিক কোলাহলের দূরে ৪৮. মোনশী গৌরিচরণ জ্যোতিষের আলোচনা করিতে ভাল বাসিতেন, তিনি প্রত্যহ প্রাতে পঞ্জিকা হইতে সেদিনকার বিবরণ কণ্ঠস্থ করিয়া রাখিতেন। জীবনরাম দাস নামক তাহার একজন হাস্যরসিক প্রতিবেশী যদিও লিখাপড়া জানিতেন না, তথাপি ছন্দোবন্দে রহস্যাত্মক কথা রচনা করিয়া মধ্যে মধ্যে গ্রামবাসিগণকে উপহার দিতেন। মোনশী মহাশয়ের পঞ্জিকা-প্রীতি দর্শনে জীবনরাম একবার নববর্ষের হাস্যাত্মক পঞ্জিকা প্রস্তুত করেন, তাহার প্রথমেই লিখিত ছিল-"অস্মিন বর্ষে গৌরী চরণ মোনশী রাজা, তস্য মন্ত্রী নিরামিয় ব্রজরাম মহাজন” ইত্যাদি। এইরূপ আরম্ভ করিয়া সেই পঞ্জিকাতে লাতু গ্রামের তৎকালীন ইতরভদ্র সকলেরই কীৰ্ত্তি উদঘাটিত হইয়াছিল।