পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৪৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বোধ হয় জগন্নাথের পূৰ্ব্বনিবাস বিদ্যাপুর গ্রাম। বিদ্যাপুর কোথায়? শ্রীহট্টে বিদ্যাপুর, বিদ্যানগর প্রভৃতি নামাত্মক একাধিক গ্রাম আছে, জগন্নাথের বিদ্যাপুর কোনটি, বলা যায় না। “গৌরদেশ" কোন দেশ? শ্রীহট্টের প্রসিদ্ধ গৌড় না কি? না শ্ৰীগৌর বিগ্রহের দেশ ঢাকাদক্ষিণই “গৌরদেশ” নামে কথিত হইয়াছে সম্ভবতঃ "গৌড়দেশ" স্থলে লিখিবার ভুলে গৌরদেশ হইয়া পড়িয়াছে; শাহজলাল কর্তৃক বিধ্বস্থ হইলেও প্রাচীন "গৌড়" নামটি অনেকেরই প্রিয় ছিল। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের পাঁচালী সম্বন্ধে এ সকল প্রশ্নের মীমাংসা ভার পাঠকের হাতে থাকাই ভাল । শ্রীচৈতন্যের পাচালীর যে প্রতিলিপি পাওয়া গিয়াছে, তাহা ঢাকা দক্ষিণের “বিশম্ভর মিশ্র কর্তৃক ১২৭৪ বাং বুধবার ১ দণ্ড থাকিতে লেখা সমাপ্ত হয়।" শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তের দ্বিতীয় ভাগ ১ম খঃ ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের টীকায় শ্রীহট্টবাসী রঘুনাথকৃত বাবাম্বর নামক আর একখানা পাঁচালীর পরিচয় দেওয়া হইয়াছে। তদ্ব্যতীত শণির পাচালী, ঘোর মঙ্গল চণ্ডীর পাচালী, হাস্য নাথের পাঁচালী, ত্রিনাথের পাঁচালী প্রভৃতি অনেক পাঁচালী গ্রন্থ প্রায় এক সময়ই শ্রীহট্টের ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থাকার কর্তৃক রচিত ও প্রচারিত হইয়াছিল। জগনোহন গোসাই প্রায় চারি শত বৎসর অতীত হইল, মহাপুরুষ জগন্মোহন জন্ম গ্রহণ করেন। (শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তের ৩য় ভাঃ ৪ৰ্থ খঃ ৬ষ্ঠ অধ্যায় জগন্মোহনের কিঞ্চিত কথা বলিয়াছি।) জগন্মোহনের পিতার নাম সুন্দরানন্দ, মাতার নাম কমলা। জগন্মোহন জাতিতে বৈদ্য (মতান্তরে কায়স্থ) ছিলেন। জগন্মোহনের পৈতৃক নিবাস বাঘাসুরা, তাহার স্ববংশীয় বর্গের খ্যাতি “অধিকারী,” এখনও তাহারা বাঘাসুরাতে অবস্থিতি করিতেছেন ৫২ ৫২. বাং ১৩১৯—পৌষ সংখ্যা নব্যভারতের জনৈক লেখক ইহাকে বরিশাল বাসী বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন কিন্তু তিনি একথার কোন প্রমাণ প্রদর্শন করেন নাই । ১৩২০ বাং—মাঘ মাসের নব্য ভারতে “জগন্মোহন ভগবত” অনুসারে জগন্মোহন কথা আলোচিত হইয়াছে; বিজয়া পত্রিকায় আমরাও তাহার রচিত কথা কীৰ্ত্তন করিয়াছি । লবনী দাস নামক জনৈক গোড়ীয় বৈষ্ণব জগন্মোহনের মতানুরাগী হইয়া পড়েন এবং তিনি শ্রীচৈতন্য ভাগবতের অনুকরণে জগন্মোহন ভাগবত রচনা করেন। তিনি বলেন “নিতাই গুড়রূপে হৈল জগতমোহন গোসাঞি।" আবার এক স্থলে বলিয়াছেন “শ্রীচৈতন্য জগতমোহন নিশ্চয়।” কাজেই তিনি জগন্মোহনের প্রত্যেক লীলা শ্রীচৈতন্য লীলার সহিত মিলাইয়া লিখিয়াছেন। নিমাইর জন্ম ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে হইয়াছিল, আবার যখন “চতুর্দশ শত পঞ্চাশ শত্রাদিত্য শকে মাঘি পূর্ণিমা আসি উপসন্ন হইল” তখন জগন্মোহন জনা পরিগ্রহ করেন। জন্ম তিথিটাও একরূপ মিলিয়া গেল, গ্রন্থকারের জগনোহন চরিতটা শ্রীচৈতন্য লীলার সহিত মিলিইয়া লিখিতে সাধ হইবে না কেন? শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান নবদ্বীপ, কাজেই তদীয় অবতার জগন্মোহনের জন্মস্থানের নামও দ্বীপান্তক হওয়া চাই। বৰ্ত্তমান বাঘাসুরার সন্নিকটবৰ্ত্তী তৎকালপ্রসিদ্ধ চন্দ্রপুর বা চান্দপুর গ্রাম (মেজর জে, রেনেল এফ, আর, এস কৃত ১৬৭৯ খৃঃ অঙ্কিত মেপ দেখ,) চন্দ্রদ্বীপ নামে তদীয় জন্মভূমি রূপে লিখিত হইল! জগন্মোহনের পিতার নাম ও মাতার নাম আমরা যাহা প্রাপ্ত হইয়াছি; জগন্মোহন ভাগবতে অদ্রুপ নহে, ঐ গ্রন্থে জণন্মোহনের মাতার নাম সুধাবতী এবং পিতার নাম পুরন্দর বলিয়া লিখিত, এ স্থলেও যে শ্ৰীগৌরাঙ্গের পিতা জগন্নাথ পুরন্দরের নাম অনুকৃত হয় নাই, তাহা বলা বাহুল্য। এ সব স্থলে জগন্মোহন ভাগবতের কথার অনুসরণ করা নিরাপদ নহে। আমরা সৰ্ব্বত্র ইহাব অনুসৰণ না করিয়া "জগন্মোহন চরিত্র” গ্রন্থ ও পূৰ্ব্বাপর প্রচলিত জনশ্রুতিই গ্রহণ যোগ্য মনে করিয়াছি। লবণী দাস যে গোড়ীয় বৈষ্ণুব ছিলেন, গ্রন্থের সৰ্ব্বত্র তাহার পরিচয় আছে, তিনি অনেক স্থলে অদ্বৈতবাদী জগন্মোহনের মুখে “আপনে প্রকৃতি হেন মনে কর জ্ঞান; পুরুষোত্তম পরমাত্মা ভজ মতিমান।" ইত্যাদি কথাও অলক্ষে প্রকাশিত করিয়া ফেলিয়াছেন।