পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭৬ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত তৃতীয় ভাগ-প্রথম খণ্ড পাইতে থাকে। তখন বেগমপুর হইতে আপত্তি উথাপিত হয়। প্রাতঃকৃত্য সম্পাদনের জন্য জলপূর্ণ ঘট সহ মাঠে যাওয়ার রীতি গ্রাম্য অঞ্চলে অনেক স্থলেই আছে। একদিন বেগমপুরবাসিগণ মাঠে গিয়া স্তুপীকৃত মৃত্তিকার এক দীর্ঘ জাঙ্গাল অবলোকন করিল ও অনেকে কৌতুহল প্রযুক্ত কাছে গিয়া দেখিল যে নিম্নে একখাল কৰ্ত্তন করা হইয়াছে। তখন আর বুঝিতে বাকি থাকিল না যে, অরঙ্গপুরের মোসলমানগণ বরাকনদী হইতে পশ্চিমমুখে অনেকদূর পর্যন্ত রাতারাতি এই খাল কাটিয়া অন্যায়রূপে সীমা নির্দেশ করিয়া লইয়াছে। অরঙ্গপুরের লোকেরাও আসিল। উভয়পক্ষে এতদুপলক্ষে প্রথমতঃ বাগবিতণ্ডা ও ক্রমে বিবাদ বধিয়া পরে লোষ্ট্ৰক্ষেপণ আরম্ভ হইল; অরঙ্গপুরের দল অচিরেই পৃষ্ঠভঙ্গ দিল। বেগমপুরের দল জয়শ্রী লইয়া ঘরে আসিল, কিন্তু সেই পৰ্যন্তই। স্থান দখল বিষয়ে আর কিছু হইল না। সেই খণিত খালই অরঙ্গপুরের সীমারূপে গণ্য হইয়া গেল! অরঙ্গপুর ও বেগমপুরে কেবল পূৰ্ব্বেই যে এরূপ ছিল, তাহা নহে; পরে বাজার সম্বন্ধেও এইরূপ কত মারামারির উদাহরণ আছে। মহেশ্বরাদি সাধক বেগমপুর ব্রাহ্মণের স্থান, ব্রাহ্মণগণ ওসব বিষয়ে তত লক্ষ্য রাখেন না, এইজন্যই মোসলমানগণ ছলে বলে কাৰ্য্যসিদ্ধির সুবিধা পায়; তথাপি সেই বংশে যখনই কেহ ঐদিকে মন দিয়াছেন, তখনই তিনি নিজ অধিকার অব্যাহত রাখিতে সমর্থ হইয়াছেন। এই বংশে মহেশ্বর ও অধিকারে বিস্তৃতি লাভ করিতে পারে নাই। গণিতে ইহার অদ্ভুত শক্তি ছিল, অন্যে কাগজে কলমে দুইদণ্ডে যে অঙ্ক কসিতে অসমর্থ হইত, ইনি দুই মিনিটে মুখে মুখে তাহা বলিয়া দিতে পারিতেন; দেখিয়া লোক অবাক হইত। এই সাহসী ও পর উপকারী, সুদীর্ঘ ও মহাকায় পুরুষের মৃত্যুও বড় আশ্চর্য রকমে হইয়াছিল। তাহার অসুখের সময় সহধৰ্ম্মিণী একদিন প্রাঙ্গণে স্নান করাইয়া জপ করিতে করিতে ভূমিতে ঢলিয়া পড়িলেন। তদৃষ্টে পরিজনগণ দৌড়িয়া গিয়া দেখিল যে প্রাণ ২. পূৰ্ব্বোক্ত অজ্ঞাত নামা কবি বলিতেছেনঃ “ভইনারী আইলা বাটী, পাতি বইলা পাটি। চাইলা একখান চাটি, পাইলা দুইহাল মাটি।" অর্থাৎ সই বাটিকাতে আসিলেন, (বসিতে তাহাকে পাটি দেওয়া হইলে) তিনি পাটি পাতিয়া বসিলেন। এবং (তিনি) একখানা চাটি (বা চাটাই) বিছাইবার উপযুক্ত মাটি (অর্থাৎ সামান্য একটুকু ভূমি) চাহিলেন; (তাহাতে) দুইহাল ভূমি (দানস্বরূপ) প্রাপ্ত হইলেন। ৩. পূৰ্ব্বোক্ত অজ্ঞাত কবি এ ঘটনাও স্মরণ রাখিয়াছেনঃ “একহাতে ইটা, আর হাতে লোটা । বুকে পিঠে ইটা, সে সয় কয়টা? এ কি আর মরদানি?-রাইতে মাটি কাটা! চারি চোখে করে কাম, সেইত বাপের বেটাn” অর্থাৎ বেগমপুরীদের একহাতে লোটা ছিল, তাহারা অন্য হাতে ইটা (লোষ্ট্র) লইয়া (অরঙ্গপুরীর প্রতি) ক্ষেপণ করিয়াছিল। (প্রতিপক্ষের) বুকে ও পিঠে (অর্থাৎ পথে পশ্চাতে সমানে) এটা (পতিত হইতে লাগিল;) কে কতটি সহিবে? (কাজেই পলায়ন করিল।) (তাহারা) রাত্রে মাটি কাটিয়া ছিল (ও চোরের মত খাল খনন করিয়া সীমা নির্দেশ করিয়াছিল;) ইহাতে আর পুরুষত্ব কি? যে ব্যক্তি চক্ষুর সম্মুখে প্রকাশ্যে কাৰ্য্য করিতে পারে, সেই তো (প্রকৃত) পিতার পুত্র; সেই তো পুরুষ। এই কবিতা দ্বারা গ্রাম্য কবি বেগমপুরবাসীগণের সাহসের এশংসা ও অরঙ্গপুরীদের চাতুৰ্য্যের কথাই প্রকাশ করিয়াছেন।