পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রতিবেদনও নেই। জীবন-নিরপেক্ষ নির্মাণে মুছে যাচ্ছে সত্য। পুঞ্জীভূত হচ্ছে শুধু আবর্জনাস্থূপ। এই স্কুপ নিরাকার, কুৎসিত। তবু যত পুষ্পবৃষ্টি এর উপর, কাগুজে ফুলের মালা চড়ানোর প্রতিযোগিতা। অন্ধেরা আজ পথ দেখাচ্ছে মূক ও বধির জনতাকে। কেন এমন হল? সত্তরের জলবিভাজন রেখা পেরিয়ে এসে যাঁরা আশি জুড়ে পুষ্পিত হয়েছিলেন, প্রাকৃতায়নের স্পন্দনে যাঁরা বিকল্প নন্দন ও বিকল্প বয়নের প্রস্তাবনা করেছিলেন—পণ্য ও বিনোদনের বিশ্বায়নকে যাঁরা নব্বইয়ের গোড়ায় গ্রাহ্য করেননি, ক্রমশ কেন সর্ষের মধ্যেও ভূত ঢুকে পড়ল? সাহিত্যের রসুইঘরে শামিল হওয়ার জন্যে ব্যগ্র উৎকণ্ঠা হঠাৎ এত সংক্রামক হয়ে উঠল কেন? লিখন-প্রণালী থেকে কেন ঝরে যেতে লাগল দ্বিরালাপ, সাহস ও প্রত্যয়! নান্দনিক ও সামাজিক ভাবাদর্শের অন্বয়সূত্র আরও বেশি মাত্রায় খোঁজার বদলে কেন সমস্ত ধরনের গতি ও ঔৎসুক্য হারিয়ে গেল অবসাদে। সামনের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার বদলে কেন পেছনের দিকে হাঁটার কসরত শুরু হল!

 প্রথম ধাপে স্তব্ধতা, দ্বিতীয় ধাপে আত্ম-পুনরাবৃত্তি, তৃতীয় আত্মপ্রতারণা এবং চতুর্থে আত্মবিনাশ। এইসব পর্যায়ে কেবল সাহিত্যের তন্তুবয়ন, অভ্যাসের পরম্পরা চালাকি দিয়ে ঢেকে রাখার কৌশল অর্জন। জীবন থেকে আশ্চর্যকে মন্থন করতে পারে না এই প্রকরণ! পারে না, কারণ আঙ্গিক ও অন্তর্বস্তুর গ্রন্থনাকে নির্মম ভাবে ভাঙার কথা তা। দূরতম কল্পনাতেও আনতে পারে না। যা পারে তাকেই বলছি লেখা। কিন্তু সেই ঈপ্সিত লিখন প্রণালী তো ভীরু ও লোভীদের জন্যে নয়। জীবনের পরম প্রাপ্তির জন্যেই যে জীবনের শীর্ণ-ক্লিষ্ট গণ্ডিকে পেরিয়ে যেতে দ্বিধা করে না, লেখা কেবল তার জন্যে। নানা ধরনের গণ্ডি তো আগেও ছিল। গত দু-তিন বছরে কেন তবে এত বিস্তার ঘটল বদ্ধতার, অন্তঃসারশূন্যতার? বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাওয়ার বার্তা শঙ্খ যদিও দিয়েছিলেন দুই দশক আগে, সাম্প্রতিক পর্বে এই বার্তার অন্তর্বর্তী সংকট ও তীব্র বিপন্নতা যেন আমাদের বিদ্ধ করছে। ছোট ছোট বৃত্তে আমাদের জীবনকে ভাগবাটোয়ারা করে থেমে থাকছি না, ইতিহাসের যাবতীয় মানবিক উপাদান শুষে নিয়ে ঘৃণা, বিদ্বেষ আর বিচ্ছিন্নতার পাথুরে দেওয়াল গড়ে তুলছি। অপব্যাখ্যা করছি সমস্ত কিছুর। প্রতিষ্ঠার চুড়োয় উঠার সহজ পথে যেহেতু বহুজনের পদচারণা, নিজস্ব গোষ্ঠীতে যুথপতি হওয়ার জন্যে মুখোসের শিল্পিত বিন্যাসে নিজের অক্ষমতাকে আড়াল করে নিচ্ছি। যদি শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে শেষ হত অধ্যবসায়, কথা ছিল না। হীনমন্যতা-ঘৃণা-বিদ্বেষ সম্বল করে লোককথার শেয়াল পণ্ডিতের মতো একটা কুমিরের বাচ্চাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছি। গোটা মানুষের অবয়ব কেউ চায় না; যে-সমস্ত সমস্যা এই তৃতীয় সহস্রাব্দের বিহানবেলায় কারও চিন্তার মধ্যেও নেই, তাদের কবর খুঁড়ে তুলে এনে কেবলমাত্র জাতপাত আর অস্তিত্বহীন বর্ণব্যবস্থার দোহাই দিয়ে সমাজ-পরিবেশকে কলুষিত করছি। এতে কেউ কেউ যূথপতি হতে পারছেন বটে অতি দ্রুত, কিন্তু বহুধাবিভক্ত আধা-ঔপনিবেশিক সমাজে প্রতিক্রিয়াশীল প্রতাপের তাতে পোয়াবারো। বর্ণলিঙ্গবর্গবাদী ইতিহাস থেকে প্রান্তিকায়িত জনের উচ্চারণকে যদি সমগ্রতার দ্যোতনায়

১০৭