পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কার্যকরী প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা হিসেবে মৃত্যুশাসিত জীবন থেকে আমাদের পাঠকৃতি আহরণ করতে হয় বলে প্রতিটি পর্যায়ে বাস্তবকে রূপক আর রূপককে বাস্তব হয়ে উঠতে দেখি। এই দেখা যার মধ্য দিয়ে জেগে ওঠে, তাকেই বলি লেখা। এই দেখাতে পাঠকের সঙ্গে লিখিয়ের মনোমৈত্রী গড়ে ওঠে। তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিকায়িত মানুষ এই মৈত্রী সংগঠনের জন্যে যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাস বিনির্মাণ করে। যিনি কবিতায় ও আখ্যানে এই প্রক্রিয়ার প্রতিবেদনকে তুলে ধরেন, তিনি আসলে সাংস্কৃতিক রাজনীতির আয়ুধ শানিত করে তোলেন। অতএব কোনো প্রচলিত বান্ধ বা উচ্চারণকে অস্বীকার করা মানে ধারণাগত অভ্যাস প্রত্যাখ্যান করে সজীব নতুনের প্রতিষ্ঠা। অজিত চৌধুরীর সাম্প্রতিক দেরিদা-ভাষ্যে তৃতীয় বিশ্বের বৌদ্ধিক দৃষ্টিকোন ব্যক্ত হয়েছে তাই: ‘deconstruction is production of meanings out of meanings by inverting the hierarchy of words/concepts within a text—its interior inaudible voice made loud.’ (১৯৯৭: ৪)। শুধু লক্ষ রাখতে হয় এইটুকু, প্রতিবেদন থেকে কোনো অজুহাতেই যেন মানুষ নির্বাসিত না হয়। সময়ের উত্তাপে কবিতার ভাষা, আখ্যানের অন্তর্বয়ন ঝলসে যেতেই পারে। নন্দনের মাত্রাবোধও রূপান্তরিত হতে পারে মুহুর্মুহু। কিন্তু তাতে লেখার সজীবতাই তো আরও তীক্ষ্ণ হওয়ার কথা; সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রকে প্রত্যাঘাত করার কথা। উল্টো ঘটনা যদি ঘটে, বুঝতে হবে, গোড়ায় গলদ রয়ে গেছে কোথাও।

 সময় অবিভাজ্য। তবু বর্তমানের সত্তাতত্ত্ব আর জ্ঞান ও প্রতাপের যুগলবন্দি ওই সময় থেকে নানা তাৎপর্য নিঙড়ে নিচ্ছে। লেখা ততক্ষণ জীবন্ত থাকে যতক্ষণ তাৎপর্য সন্ধানের জন্যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগোয়। জয় গোস্বামীর উচ্চারণে ‘আমরা যা করি ব্রহ্ম তা-ই আজ ব্রহ্ম তা-ই আজ ব্রহ্ম তা-ই’ আসলে সময়মথিত উচ্চারণ। তার ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ বা ‘ভূতুম ভগবান’-এর মধ্যে আত্মবিনির্মাণের তাগিদ প্রবল বলেই বাচনের প্রাতিষ্ঠানিকতা ভেঙে দিতে পেরেছিল ওই সংকলন দুটি। কিন্তু স্বরচিত অভ্যাসের মোহিনী মায়া অনতিক্রম্য হয়ে রইল বলে ‘আজ যদি আমাকে জিগ্যেস কর’ গেছে লেখার বিপ্রতীপে। জয়দেব বসু বা সুবোধ সরকারের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। রাহুল পুরকায়স্থ বা তরুণতর কবিদের মধ্যে কজন সাহিত্যের সর্বগ্রাসী মায়াবী ফাদ থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারছেন? কজন লিখতে পারছেন: ‘ভাঙন পিছন থাক, সম্মুখে নির্মাণ’? বাংলার বিপুল লিখনবিশ্বে শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ-রফিক আজাদ-মোহম্মদ রফিক-নির্মলেন্দু গুণদের মধ্যেও কি অভ্যাসের প্রাতিষ্ঠানিকতা তাঁদের বৈচিত্র্য ও অগ্রগতিকে স্তিমিত করে দেয়নি? খোন্দকার আশরাফ হোসেন-ফরিদ কবির-জিললুর রহমান-মাসুদ খান-তুষার গায়েন-মোস্তাক আহমেদ দীন-দের মতো আরও কিছু তরুণতর কবিদের মধ্যে যদি লেখার বিদ্যুৎচমক লক্ষ করি, তাহলে, বুঝতে হবে, এঁরা আত্মবিনির্মাণে তৎপর রয়েছেন। কথাকারদের মধ্যে কমলকুমার মজুমদার একথা সবচেয়ে ভালো জানতেন বলে ভাষাকে আক্রমণ করেই ভাষাকে বাঁচাতে চেয়েছেন। তৃতীয় বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে সংগঠিত তার লিখনবিশ্ব; অতীত

১১১