পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আগুন অসুখ দুই হাতে সব খায়
পাক থেকে ওঠা, ক্ষিপ্ত সব্যসাচী।’

 এই যে ‘লুপ্ত মানুষ খুঁজবার কোলাহল’, তা প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যে নেই; মৃত্যু থেকে জীবনে পৌঁছানোর জন্যে কোনো গোপন সুড়ঙ্গপথ আবিষ্কার করার তাগিদও তার থাকে না। এই পথের পাথেয় সংগ্রহ করে শুধুমাত্র লেখা।

 এই নিবন্ধের সূচনায় আত্মদ্রোহের প্রদর্শনীতে কণ্টকিত বাংলা সাহিত্য জুড়ে লক্ষ করেছিলাম চোরাবালির প্রসার আর ঢোলবাদ্যের কসরত। আশঙ্কা জেগেছিল, লেখা হয়তো নেই কোনোখানে। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক ঔদ্ধত্য সত্য উৎপাদন করে না কেবল, ভালো-মন্দ সার্থক-ব্যর্থ প্রচারযোগ্য-হননযোগ্য ইত্যাদি লেবেলও এঁটে দেয়। কিন্তু এই স্বৈরতন্ত্রী পীড়ন যদি শেষ সত্য হয়, পূর্ববর্ত্ত অনুচ্ছেদের বক্তব্যকে ফাপা আশাবাদ ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। কিন্তু তা তো নয়। সমান্তরাল অপর হিসেবে লেখার অস্তিত্ব ছিল, আছে এবং থাকবে। কেননা পীড়ন যেখানে বেশি তীব্র, প্রতিরোধও সেখানে তত অনিবার্যভাবে উপস্থিত। এমন যদি না হত, ‘মানুষ’ কথাটা চিরদিনের মতো অর্থহীন হয়ে পড়ত। তবে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে লেখাকে কেবল সারস্বত আকাঙ্ক্ষা বা বৌদ্ধিক চর্যা হয়ে থাকলে চলবে না। আক্রমণ যখন সার্বিক, প্রতিরক্ষা ও প্রত্যাঘাতকে একই ভাবে সার্বিক হতে হচ্ছে। কোনো আভিজাত্য অর্জনের জন্যে নয়, লেখাকে প্রস্তুত হতে হচ্ছে অসম যুদ্ধে নেমে পড়ার জন্যে। চক্রব্যুহে অভিমন্যু যতখানি একাকী ছিল, তার চেয়ে বেশি নিঃসঙ্গ আজকের লিখিয়ে-যোদ্ধা। কারণ, ভাষা-প্রকরণ ভাষা-চরিত্র ভাষা-অনুষঙ্গ—সব কিছুকে সন্দেহ করে, পরখ করে, অন্তর্ঘাত করে সমাপ্তিবিহীন সম্ভাবনার উপকূল খুঁজে চলেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে সুবিমল মিশ্র ‘সত্য উৎপাদিত হয়’-এর প্রতিবেদনে (১৯৯৭: ২১) খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন: ‘গেরিলা শব্দ প্রয়োগ একজন লেখক-কর্মীকে প্রলেতারিয়েত করে তোলে এবং অবশ্যই পরিমাণগত ভাবে, ইনটেলেকচুয়াল আভিজাত্যের বিলোপ সাধন করে। কেননা সে মনে করে হিংসা, অপরাধ ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এসব আসলে এখনকার এই পৃথিবীতে শান্তি শৃংখলা এবং স্বাভাবিকতার সমার্থক শব্দ। আস্তে আস্তে সে এইভাবে ফাস করে দিতে তাকে এই সভ্যতার লগ্নি ও সঞ্চয়ের লুকানো খেলাগুলি, আপাতভাবে...’!

 লেখা তাহলে গেরিলাযুদ্ধ। হ্যাঁ, নিশ্চয় তাই। কারণ, স্থিতাবস্থার শৃঙ্খলকে পোক্ত করার যাবতীয় আয়োজন যখন করতে থাকে সাহিত্যের ছদ্মবেশে আবৃত উৎপীড়ক প্রাতিষ্ঠানিকতা, তখন অবক্ষয় ও বিকারের বিপক্ষে স্পষ্ট দাঁড়াতে পারাই মনুষ্যত্বের অভিজ্ঞান। কোনো সংশয় নেই যে ভয়াবহ ও নির্লজ্জ এই ‘বাণিজ্যযুগে ভাষার রহস্যময়তাও পণ্য আর পণ্যধর্মিতায় আর যাই থাক, কোনো রহস্য থাকে না’। অতএব কবিতায়, আখ্যানে বাণিজ্যিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মানে সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে আধিপত্যবাদীদের চক্রান্ত প্রত্যাখ্যান করা। ভেড়ার পালের মতো ভিড়ে মিশে না গিয়ে মেরুদণ্ডী প্রাণী হিসেবে মিথ্যা ও প্রতারণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। এর নাম লেখা, এর নাম তাৎপর্যের জন্যে যুদ্ধ।

১১৫