পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ক্ষয়িষ্ণুতার টীকা-টিপ্পনি- ভায্যের-কূটকচালিতে ব্যস্ত রয়েছেন। অথচ ব্যাপক জীবন-বিরোধী ষড়যন্ত্রের স্বরূপ অস্পষ্ট ছিল না কখনও। মুনাফা-লোভী সামাজিক বর্গের প্রয়োজনে সমস্তই পণ্য। দ্রুত পণ্যায়নের জন্যে সস্তা ও প্রগলভ চালাকি নিরঙ্কুশ এখন। মুখ সত্যিই ঢেকে গেছে বিজ্ঞাপনে।

 সংস্কৃতির সুপেয় ধারাকে মরুপথে চালিয়ে দিয়ে বিষাক্ত অপেয় করে তোলা হচ্ছে। মুষ্টিমেয় পরশ্রমজীবীর বিনোদন-সামগ্রী হিসেবে সংস্কৃতির আদলমাত্র অটুট রেখে নির্যাস নিঙড়ে নিয়ে তার খোলনলচে পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। উৎকট পণ্য হয়ে ওঠার জন্যে প্রকরণের উদ্ভট সপ্রতিভতাই যথেষ্ট। শাসক-প্রভুর উচ্ছিষ্টজীবী কৃষ্টি-ব্যবসায়ীদের মর্জিমাফিক উৎপাদিত হচ্ছে না-সংস্কৃতি। গণমাধ্যমগুলির উপরে একচেটিয়া দখলদারির সুবাদে সাধারণ মানুষের রুচিবোধ ও জীবনভাবনা এখন এদের লাগাতার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। এখন তৃষ্ণার আরেক নাম পেপসি, উচ্ছলতার আরেক নাম কোকাকোলা। এরকম অজস্র পণ্যনাম দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে দৈনন্দিনের নামাবলী। প্রতিটি ক্ষেত্রে সুচতুর ভাবে কৃষ্টির একটা আদল মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাণিজ্যে।

 এমন একটা সময় ছিল যখন বিনোদন মানে নিছক সুখের আবেশ ছিল না, তা ছিল গণমনের প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু এখন বিনোদন মানে শুধু পণ্য। যৌথচেতনায় আলোড়ন তোলে না আর পণ্যায়িত না-সংস্কৃতি। সর্বজনীন গ্রহীতার বদলে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ একক গ্রহীতার আত্মরতির সহায়ক হওয়াই তার অন্বিষ্ট। এতে অবশ্যম্ভাবী সংযোগের সামাজিক ও নান্দনিক তাৎপর্য হারিয়ে যাওয়া, ভাবাদর্শের অবান্তর হয়ে যাওয়াও। প্রযুক্তির কল্যাণে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেহেতু পৌছে গেছে ছদ্ম-সংস্কৃতির মাদক, চিরাগত পরম্পরা ধ্বস্ত হয়ে গিয়ে চিন্তা-চেতনার অনন্যতা দ্রুত মুছে যাচ্ছে। সংস্কৃতির সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত হয়ে যাচ্ছে সত্য-মিথ্যা-ভালো-মন্দ-ন্যায়-অন্যায়ের প্রসঙ্গ। জানি, ‘মেঘ ক্ষণিকের চিরদিবসের সূর্য, কিন্তু এই উচ্চারণ করে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকলে তো চলবে না। সূর্যোদয়কে ত্বরান্বিত করা আমাদেরই দায়। অন্ধকারকে অন্ধকার বলে চিহ্নিত যেমন করব, তেমনি তার বিরুদ্ধে প্রত্যয় ও উদ্যম গড়ে তোলার জরুরি দায়িত্বটি এড়িয়ে যাব না। ভুলব না যে সংস্কৃতির প্রশ্নটি আসলে মানুষের সপক্ষে দাঁড়ানোর প্রশ্ন, জীবন ও জগতের নিরন্তর পুনর্নির্মাণের প্রশ্ন, ভাবাদর্শের তাৎপর্য বুঝে নিয়ে তার প্রতি অবিচল থাকার প্রশ্নও।

 আর, ঠিক এখানেই সঠিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে প্রাণবান করার জন্যে জোট বাঁধার প্রশ্নটি এসে পড়ে। কী ও কেন আসলে একসূত্রে গাঁথা। বৃহত্তর জনজীবনের প্রাঙ্গণে পৌছাতে চাই আমরা, সুস্থ ও উদ্দীপ্ত জীবনবোধে অনুপ্রাণিত সংস্কৃতি আমাদের পাথেয়। মূলপথের পাশ কাটিয়ে শাখা-পথ ধরে যাঁরা তথাকথিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান, তাঁরা ভ্রান্ত। স্রোত যদি ভুল উচ্ছ্বাস তৈরি করে, প্রাণপণ শক্তিতে যেতে হবে

১২৩