পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তর্ক করে যায়। একথার দ্যোতনা হচ্ছে, তর্ক হোক, তা যেন বেদের বিরুদ্ধতা না করে। সোজা ভাষায়, আধিপত্যবাদীদের মূল ভাবাদর্শে কোথাও আঁচ লাগা চলবে না। মুশকিল হচ্ছে, নাস্তিক তার্কিকেরা এই সহজ কথাটি মানে না। তাদের জন্যে মহাকাব্যে-পুরাণে-স্মৃতিশাস্ত্রে নানা ধরনের গল্প তৈরি করে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মহাভারতে যেমন শান্তিপর্বের একটি আখ্যানে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র শেয়ালের ছদ্মবেশ ধরে আত্মহত্যায় প্রস্তুত কোনো-এক ব্রাহ্মণকে সাবধান করে দিয়েছেন। সেখানে দেখতে পাচ্ছি, যুক্তিবাদী ব্রাহ্মণ যদি নাস্তিকদের মতো বেদকে নিন্দা করে, তাহলে সে শেয়াল হয়ে জন্ম নেয়। (শান্তি:১৮০:৪৭-৪৯) দৃষ্টান্ত আর বাড়িয়ে লাভ নেই। দু-হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আধিপত্যবাদী বর্গ সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে এসেছে নিতান্ত শ্রেণী-স্বার্থে। উল্টোদিকে, অজস্ব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আস্তিক্যবাদের অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করার জন্যে সচেষ্ট থেকেছেন যুক্তিবাদী চিন্তাবিদেরা। একই সঙ্গে সামাজিক অচলায়তন ও রাজনৈতিক শোষণের যুগলবন্দির বিরুদ্ধেও তাদের প্রতিবোধ। চার্বাক সম্প্রদায় এই প্রতিভাবাদর্শের সর্বোত্তম প্রকাশ। তাদের অভিমত হিসেবে মাধবাচার্য সর্বদর্শন সংগ্রহে যেসব বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তা বিশ্লেষণ করলেই নাস্তিক্যবাদের জীবনমুখিনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুতরাং নামের মধ্যে যদিও নেতির দ্যোতনা অত্যন্ত প্রবল, তবু কার্যত এরাই জীবন ও জগৎ-সংলগ্নতার জোরে সবচেয়ে ইতিবাচক মনোভঙ্গির অধিকারী। তথাকথিত আস্তিক্যবাদীরা যখন প্রত্যক্ষগোচর জীবনকে না-এর ধোঁয়াশার আড়ালে সরিয়ে দেয়, নাস্তিক্যবাদীরা সেসময় জীবন ও জগতের প্রতি গভীর মমতায় খুঁজে পান ‘আছে আছে আছে এই বার্তা।

 এমন নয় যে অস্তি নাস্তির এই মিথ্যা দ্বন্দ্ব বিজ্ঞানের যুগে ঘুচে গেছে। অত্যন্ত পরিতাপের কথা, আপাতদৃষ্টিতে প্রাগ্রসর ব্যক্তিও আস্তিক্যবাদী ভাবাদর্শের আকর্ষণে দর্শনশূন্য ধর্মসংস্কারে আপাদমস্তক নিমজ্জিত হয়ে পড়ছেন। বিজ্ঞানের সঙ্গে বিচিত্র সহাবস্থান চলেছে ধর্মীয় অভ্যাসের। এমনকি, গত কয়েক বছরে মনে হচ্ছে, গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনার পুনরুত্থান হচ্ছে। ধর্মীয় উন্মাদনা যে-পরিমাণে যুক্তিবাদকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে, ঠিক সেই অনুপাতে বেড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। প্রত্যেকের জন্যে স্বাস্থ্য প্রত্যেকের জন্যে শিক্ষা প্রত্যেকের জন্যে খাদ্য: এই ন্যূনতম দাবি মেটাতে যখন অপারগ হয় রাষ্ট্র, নানা ধরনের সূক্ষ্ম ও স্থূল উপায়ে সুড়সুড়ি দেয় আস্তিক্যবাদী চিন্তাপ্রকরণে। সাম্প্রতিক কালের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি, দর্শনের সমর্থন নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামাচ্ছে না। পরম্পরাগত ব্যবহারিক অভ্যাসকে আঁকড়ে ধরছে যারা, তাদের কাছেও বাস্তব চাওয়া পাওয়া মুখ্য। স্থিতাবস্থা অক্ষুন্ন থাকুক, এই তো চায় রাষ্ট্রশক্তি এবং পৌর সমাজেও অনুকূল বাতাবরণ অটুট রাখতে চায়। যতভাবে সম্ভব, লোভের আগ্রাসন বজায় রাখে; তাতে মনুষ্যত্ব-মূল্যবোধযুক্তি জাতীয় শব্দ নিতান্ত অবান্তর। ভোতা-নিপ্রাণ-স্থূলতাক্লিষ্ট জগৎ স্থবির থেকে

১৩৬