পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অতিপরিশীলিত সপ্রতিভতার মোড়কে। ভঙ্গিসর্বস্বতা যেখানে শেষ কথা, তাতে লিটল ম্যাগাজিনের পতাকা বহন গভীরতর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়ের সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত হতে বাধ্য। এইজন্যে আরও একটু নাম, আরও একটু দাম পাওয়ার তাড়নায় প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির কৃপাধন্য হওয়ার উপযোগী প্যাচ-পয়জার করতে এদের দ্বিধা হয় না। স্বভাবত এরা কাকের ঘরে কোকিল; বাসা ভেঙে উড়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়তো কোনো প্রাসাদের সুরম্য বারান্দায় খাচার নিরাপদ ঘেরাটোপে এদের অধিষ্ঠান হয়। বাঁধা সময়ে বরাদ্দ ছোলা খেয়ে কখনো সুখে শিস দেয় আর কখনো শেখানো বুলি আওড়ায়। গন্তব্যের, ভাবাদর্শের, প্রাসঙ্গিকতার বালাই নেই এদের। লিটল ম্যাগাজিনের অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা এদের পক্ষে দুর্বোধ্য গ্রিক।

 প্রতিষ্ঠান এইসব কোকিলের দস্তুর জানে। এদের খাঁচাবন্দী করতে যে দুটো চারটে দানাই যথেষ্ট, একথা প্রাতিষ্ঠানিক মোড়লদের বুঝতে দেরি হয় না। সুতরাং বড়শির চারা হিসেবে খানিকটা গুরুত্ব দিয়ে অচিরে ভুলে যায় এদের। কিন্তু সংশয়ের আঁধি তৈরি করা যেহেতু প্রতিষ্ঠানের রণকৌশল, লিটল ম্যাগাজিনের অনেক সৎ সৈনিক সহজ বুদ্ধির জন্যে এই শিবির বদলের আসল তাৎপর্য অর্থাৎ সংশয়ের তাৎপর্যহীনতা বুঝতে পারেন না। তাদের মধ্যে দ্বিধা ও দুর্বলতা দেখা দেয়, হতাশা প্রস্তুতিপর্বকে আচ্ছন্ন করে, পথ চলার শক্তি সংহত করার বদলে কেউ কেউ নেতির চক্রব্যুহে ঢুকে পড়েন। প্রতিষ্ঠান তো তা-ই চায়। আর, যাঁরা নাছোড়বান্দা হয়ে তবু এগিয়ে যেতে চান, তাদের জন্যে প্রতিষ্ঠান ওইসব বড়শির চারাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে। অন্তর্ঘাত কীভাবে কখন নিঃশব্দে ঘটে যাচ্ছে, সততা ও মৌলিক চিন্তা নিয়েও ছোট পত্রিকার মশালচিরা তা বুঝতে পারেন না। চোরাবালিতে যখন কোমর অব্দি ডুবে যায়, সেসময় কেউ কেউ হয়তো ছটফট করে ওঠেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সম্মোহন, বহুশ্রুত, প্রায় ক্লিশে হয়ে-যাওয়া, বাক্যবন্ধ ব্যবহার করে লেখা যেতে পারে, এর মোহিনী মায়ায় কত ডাকসাইটে বিপ্লবীর পথ বেঁকে গেছে গাস্থ্যের দিকে। এইসব প্রাক্তন বিপ্লবীদের সাম্প্রতিক অবস্থান জীবনানন্দ কথিত শতশত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বরকে যতই মনে করিয়ে দিক না কেন, অস্বীকার করার উপায় নেই যে লিটল ম্যাগাজিনের কোনো কোনো অর্জুনের হাত থেকে গাণ্ডীব খসে পড়ছে পিতামহ ও পিতৃব্যদের বিপক্ষ শিবিরে দেখে। যেহেতু এইসব প্রাক্তন প্রিয়জনদের ডিগবাজি-কুশলতা ভাবাদর্শের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে আজকের সেনানীদের সন্দিহান করে তুলছে, ইতিহাসের আবর্জনাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করার দায় স্বীকার করাটা ছোট পত্রিকার পতাকাবাহীদের অবশ্যকৃত্যের মধ্যে পড়ে। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার চতুর খেলাকে যে ঘৃণা করতে শেখেনি, লিটল ম্যাগাজিন কিছুতেই তার জন্যে নয়।

 আধিপত্যবাদ চিরকালই সুস্থ চিন্তার সবচেয়ে বড় শত্রু। চিন্তায় পক্ষাঘাত ঘটিয়ে দেওয়ার জন্যে অনবরত কলকাঠি নেড়ে যায় আধিপত্যবাদের নায়েব-গোমস্তা-দালালের

১৪২