পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মানুষের বাঁধা হয়ে যাওয়াতে কোনো অস্বস্তি জাগে না মনে। বরং নিশ্চেতন মনে আসে নিরাপত্তা ও আশ্বাসের বোধ। কুকুরের পাকস্থলি পরিষ্কার হওয়ার সঙ্গে অদৃশ্য শেকলে জড়িয়ে গেছে আসগর নামক এক সুযোগ-সন্ধানী মানুষের প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা। এই শেকল বিমানবায়িত সমাজ-ব্যবস্থার যেখানে উচ্চবর্গীয় অবস্থান অর্জনের সুবাদে চরম অন্তঃসারশূন্য মানুষও সর্বত্র দাপট দেখিয়ে বেড়াতে পারে। অথচ শেকল ছিড়তে পারে আসগরের মতো উজীবী প্রান্তিক মানুষেরা। গল্পকারের মুন্সিয়ানায় যুগলবন্দি কেবল মানুষ ও পশুর জান্তব সত্তার মধ্যে ব্যক্ত হয়নি, আরো বড়ো আরো অমোঘ শেকলের ছায়ায় বেজে চলেছে অন্য এক তিক্ত কষায় যুগলবন্দির মূর্ছনাও। আসগরের ভাবনায় সরোয়ার কবিরের উপস্থিতি যেভাবে প্রকট হয়েছে, তার শব্দমধ্যবর্তী শূন্যায়তনের যথার্থ ভাষ্য করলেই ওই যুগলবন্দি অনুভব করতে পারি। এঞ্জিনিয়রদের সে সিমেণ্ট-বালির অনুপাত সম্বন্ধে উপদেশ দেয়, এ্যাণ্টিবায়োটিক কোথায় প্রয়োেগ করা উচিত তা শিখিয়ে দেয় ডাক্তারদের, কলেজের বুড়ো প্রফেসার দ্যাখা করতে এলে তাকে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে ক্লাসে রোলকল করার সঠিক ও আধুনিক পদ্ধতি বুঝিয়ে দিয়েছিল। ঝাড়ুদারকে ঝাড়ু ধরার কায়দা দেখিয়ে দেয়, আইন গাইনের যথাযথ উচ্চারণ সম্বন্ধে তার এলেম জবরদস্ত আলেমদের স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। মেয়েদের পটাবার বিদ্যায় সুপ্রতিষ্ঠিত লম্পটদের সে হার মানাতে পারে, কুকুর কখন কী খেতে ভালোবাসে সংশ্লিষ্ট কুকুরদের চেয়ে সে ভালো জানে!’অথচ এমন লোককে জেসমিন ‘রাস্টিক’ বলে গালাগাল দেয়। স্ত্রীর সামান্য অসন্তুষ্টিও তাকে বিচলিত করে।

 তাই গল্প পড়া যখন শেষ হয়ে আসে, আমাদের বিশেষ ভাবে লক্ষ করতে হয়: ‘পাকস্থলিতে শেষ শীতের নির্মল হাওয়া বইতে থাকলে আরগসের আরাম ও তৃপ্তিতে আসগরের ডান হাতে বাঁধা শেকলে রিনি ঝিনি আওয়াজ ওঠে, আরগসের সঙ্গে আসগরও রীতিমতো দৌড়াতে থাকে সরোয়ার কবিরের কাছে পৌছানোর জন্যে। এই ধাবমানতায় গল্পের বয়ান সমাপ্ত হয়; আমরাও অনুভব করি, চিহ্নায়িত এই ক্রিয়াপদের বিচ্ছুরণ অব্যাহত থাকবে এ সমাজে। এ যুগলবন্দি সহজে থামবে না। কিন্তু একথা ভেবেও কি খটকা জাগে না কে বেশি করুণ জীব: আসগর না সরোয়ার? কার কাকতাড়ুয়া মূর্তি শেষ পর্যন্ত প্রবলতর হয়ে উঠল পাঠকের মনে? অন্তত গল্পকারের অভিপ্রেত কি নয় কার্নিভালের তুমুল হাসির তোড়ে সরোয়ারের আমলাতান্ত্রিক পরিসর থেকে সব প্রসাধন মুছে নেওয়া? এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আসগরকেও যেন তত কালো মনে হয় না আর।

 এক প্রশ্ন থেকে অন্য প্রশ্নের বিচ্ছুরণে নিয়ে যায় বলেই ‘যুগলবন্দি’র পুনঃপাঠ চলতে থাকবে আরো অনেকদিন।

১৭৬