পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কিন্তু সেইসব অভ্যন্তরীন সংকটেরই প্রমাণ। পাশাপাশি রয়েছে খাসিয়া, গারো, মিজো, মণিপুরি, ডিমাসা, কার্বি প্রভৃতি জাতি বা গোষ্ঠীর লোকায়ত বিশ্ববীক্ষা প্রসূত মৌখিক সাহিত্য নির্ভর পরম্পরা। এদের মধ্যে মণিপুরি অবশ্য সাহিত্যিক সংরূপের নিরিখে বেশ খানিকটা এগিয়ে। কিন্তু এ অঞ্চলের বাংলা-অসমিয়া-হিন্দি সাহিত্যের প্রতিতুলনায় তা তেমন কিছু নয়। সবচেয়ে পরিতাপের কথা, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী হয়েও এরা পরস্পর সম্পর্কে উদাসীন এবং অনাগ্রহী। নইলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অনুবাদ সাহিত্য গড়ে উঠল না কেন? এইজন্যে অনন্ত তাতী যখন চমৎকার অসমিয়া কবিতা লেখেন, ভক্ত সিং ঠক্করী মৈমনসিংহ গীতিকাকে বাংলা থেকে নেপালিতে অনুবাদ করেন, হিন্দিভাষী অশোক বার্মা বাংলায় কবিতা লেখেন, খৈরউদ্দিন চৌধুরী বাংলা ও মণিপুরি ভাষায় কবিতা চর্চা করেন, বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষী সমরজিৎ সিংহ বাংলা কবিতার প্রবাহে যুক্ত হন। মনে হয়, হ্যা, এই ছিল উত্তর-পূর্বের স্বভাবের পথ। ভাষা এখানে বন্দিশালা হওয়ার কথা নয়, তা চেতনায় সেতু নির্মাণের আয়ুধ হতে পারত।

 তার মানে, উত্তর ঔপনিবেশিক প্রতিস্পর্ধার যথার্থ আয়োজন হতে পারত অনেকান্তিক ভাষা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। বহুবাচনিকতার প্রকৃত নিরীক্ষাভূমি হিসেবে গড়ে উঠত যদি উত্তর-পূর্বাঞ্চল, অরূপা পটঙ্গিয়া কলিতা কিংবা সৌরভকুমার চালিহার অসমিয়া ছোটগল্প কারো অনুরোধের অপেক্ষা না করেই অনূদিত হত বাংলায়, মণিপুরিতে, খাসিয়ায়। অথবা নীলমণি ফুকন ও হীরেন ভট্টাচার্যের কবিতার পাশাপাশি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য, উদয়ন ঘোষ, প্রবুদ্ধসুন্দর করদের কবিতা সমান আগ্রহে পড়তেন সমস্ত ভাষাগোষ্ঠীর পড়ুয়ারা। মিথিলেশ ভট্টাচার্য, শেখর দাশ, রণবীর পুরকায়স্থ, দুলাল ঘোষ, দেবব্রত দেবদের বাংলা ছোটগল্প ইন্দিরা গোস্বামী, বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, যোগেশ দাস, জোহিরুল হুসেইনদের অসমিয়া আখ্যানবিশ্বে সম্পৃক্ত হত সৃজনশীল দ্বিবাচনিকতার সামর্থ্যে। বহুবাচনিক এই ভুবনে প্রতিটি সত্তা হত অপর সত্তার সহযোগী ও পরিপূরক। আর, মিথস্ক্রিয়ায়, শৌর্যে ও সৌন্দর্যে ঋদ্ধ হত উত্তর-পূর্বাঞ্চল নামক দূরীকৃত অপর পরিসরের বাসিন্দা বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যিক সমাজ। হল না যে, সেইজন্য কি পুরোপুরি দায়ী অভ্যন্তরীন ঔপনিবেশিকতা? নাকি দেশভাগ ও প্রব্রজনের সহগামী সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বহুবিলম্বিত প্রতিক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক যে-মানচিত্রটি চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে, তার হাঁ-মুখ গহ্বরের শূন্যতা আমাদের সামূহিক সত্তাকে যাবতীয় সংলগ্নতাবোধ সহ গ্রাস করে ফেলেছে: আমাদের জন্যে তাই রয়ে গেছে গন্তব্যহীন যাত্রা- ‘gesture without motion’।

 কিন্তু কী হল না অথচ হওয়ার কথা ছিল—এই নিয়ে আক্ষেপ করা অর্থহীন। কেন হল না, তা নিশ্চয় ভাবা যেতে পারে। তবে কোনও একটি ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে সেই গণ্ডির প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়ে যদি ভাবি, তা হলে বড় পরিসরের সঙ্গে দ্বিবাচনিকতার নান্দনিক ও ঐতিহাসিক প্রয়োজন অস্পষ্টই রয়ে যাবে। তাছাড়া তথ্য

১৮৫