পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কালবেলা: মোহিনী আড়াল: ভ্রমকথা

 শিরোনাম নিয়ে নিবন্ধ-প্রয়াসীর কিছু লেখার রেওয়াজ নেই। অনেকদিন আগে যেমন বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, আমাদিগের (অর্থাৎ লেখকদের) আত্মপরিচয় আপনি দিবার রীতি নাই। কিন্তু ইদানীং সমস্ত কিছুই ‘চলে যায়। অতএব শিরোনাম প্রসঙ্গে লিখছি, না, গুরুতর কোনো কথা নয়। এইমাত্র যে, মনের মধ্যে লেখার বিষয়টি যখন দানা বেঁধে উঠেছে, ভাবছিলাম, নাম হোক; সময়ের সাহিত্য, সাহিত্যের সময়। একটু পরে নিজেরই খটকা লাগল ‘সাহিত্য কথাটা নিয়ে। সাহিত্য লিখব না কি সন্দর্ভ, সাহিত্য শব্দটা বড্ড বেশি ফর্মাল, আনুষ্ঠানিক, প্রাতিষ্ঠানিক, গুরুগম্ভীর। এখন তো ‘এক্রিচার’-এর যুগ, টেক্সট বা বয়ান লেখা ভালো। সময়ের বয়ান হতেই পারত, সঙ্গে বয়ানের সময়। তারপর ভাবতে শুরু করলাম, চোখের সামনে সময়’ এর মতো উদাসীন, নিরপেক্ষ, দার্শনিক শব্দটিও কেমন যেন পানসে, জলো হয়ে গেছে। সময় থেকে নির্যাস শুষে নিয়েছে তথ্যের, পণ্যের সম্মোহন ছড়ানো গণমাধ্যম। একেবারে সন্ত্রাসবাদীর কায়দায় ব্যক্তির দখল থেকে সময় ছিনিয়ে নিয়েছে কে বা কারা। ই-মেল ইণ্টারনেট সাইবার কাফে ই-কমার্স ইত্যাদি শব্দাবলী সামুদ্রিক তুফানের মতো আছড়ে পড়ছে আমাদের ওপর। ডট কমের তুমুল সন্ত্রাসে ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে ব্যক্তি-সমাজ-ঐতিহ্য-সম্পর্ক ইত্যাদির বোধ। প্রবল পরিহাসের মতো এল বলে সাহিত্য। কিছুদিন পরেই হয়তো এরকম নিবন্ধ-প্রয়াসের কোনো প্রয়োজন থাকবে না।

 ভাবতে ভাবতে মনে এল জীবনানন্দের বেলা-অবেলা-কালবেলার কিছু কিছু বাচন। হ্যা, সময়ের ভব্যসব্য আশালতা শুকিয়ে যাচ্ছে যখন, কালবেলা ছাড়া কী বা বলা যায় একে। গত কয়েক বছরে দেখলাম, কী অসামান্য দ্রুততায় ও দক্ষতায় শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিতদের তফাত মুছে দেওয়া হল। চ্যানেলে চ্যানেলে নির্বোধ সিরিয়্যালের দাপটে সামাজিক বিনিময়ের সমস্ত সেতু একে একে ভেঙে পড়ল। বই। পড়া নামক অভ্যাস হয়ে দাঁড়াল আদিখ্যেতা। একেকবার একেকটা জোর এল মেগা-সিরিয়ালের; তখন সেই কানু ছাড়া গীত নেই আর। স্টার টি.ভিতে যেমন কৌন বনেগা ক্রোরপতি। উপগ্রহ-প্রযুক্তির উপর একাধিপত্যের সুযোগে বিশ্বপুঁজিবাদের মোড়লেরা ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতিগর্বী বাঙালিদের পর্যন্ত দোঁ-আশলা, তে-আঁশলা জীবে পরিণত করছে। নিকৃষ্ট সামন্তবাদী অপচেতনা ও নির্বিচার ভোগবাদী প্রতীকের ককটেল ইতিমধ্যে বাঙালির ভুবনকে অনেকখানি কলুষিত করে দিয়েছে। হাঁসজারু ও বকচ্ছপদের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্বাতন্ত্রের অভিজ্ঞানগুলি। সবচেয়ে মারাত্মক কথা, আমাদের শিশু ও কিশোরেরা হয়ে উঠছে দম-দেওয়া পুতুল, পরগাছা ও উৎকেন্দ্রিক। সাহিত্যের সমস্ত পরিচিত আড্ডায় এবং গত কয়েক বছরে বইমেলাগুলিতে ছোট পত্রিকার সমাবেশগুলির দিকে তাকালেই খালি চোখে ধরা

১৫