পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চূড়ান্ত বলে তর্কের খাতিরেও মেনে নিতে পারছি না। সব ধরনের ভাবাদর্শ, স্বপ্ন, বিশ্বাস, কিংবা নির্মাণ-আকাঙ্ক্ষাকে মহাসন্দর্ভ বলে প্রত্যাখ্যান করাই রেওয়াজ এখন। ‘সকলেই আড় চোখে সকলকে দেখে। তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আজ? ইতিহাসের দিকে তাকাতে পারছি না কেননা ইতিহাস মানে পিঞ্জর, ইতিহাস মানে আধিপত্যবাদের চতুর নির্মিতি। চরম বিমানবায়নের এই পর্যায়ে জৈবপ্রযুক্তি ও জৈবরসায়ন বিদ্যা মানুষের বহু সহস্রাব্দব্যাপী ধারাবাহিকতাকে ভেঙে চৌচির করে দিচ্ছে। বিশ্বায়নের নামে সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিঃশেষে মুছে দিচ্ছে অপ্রতিরোধ্য তথ্যবিননাদনের নয়া উপনিবেশবাদ। এসময় দার্শনিকেরা ভাবছেন অস্তিত্বের প্রত্নতত্ত্ব বা জ্ঞানের প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে। পরিণামে লেলিহ জিহ্বা দিয়ে আত্মসম্মোহন আমাদের ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানকে চেটে পুটে খাচ্ছে। সব কিছুই যখন ‘ভবিষ্যৎ অতীত’, আমাদের সাহিত্যবোধ বা নন্দনচিন্তা দাড়াবে কোন্ ভিত্তির ওপরে?

 সর্বত্রব্যাপ্ত বিভ্রমের এই কালবেলায় পুরনো ধাঁচের বয়ান কোথাও তো প্রাসঙ্গিক থাকছে না। সমস্তই আপেক্ষিক এবং সাময়িক যখন, ভিত্তি কিংবা অন্বিষ্ট অবান্তর হতে বাধ্য। গত চার-পাঁচ বছরে চোখের সামনে জীবনবোধ হয়ে উঠল রঙিন মরীচিকা। ফলে আখ্যান থেকে ঝরে গেল ঋজুতা ও সত্যের নিষ্কর্ষ; কবিতার বাচন থেকে চিহ্নায়কের দ্যুতি। এটা ঠিক, উপন্যাসে ছোটগল্পে নানাধরনের অভিনবত্ব দেখা যাচ্ছে ইদানীং। কিন্তু মানুষের দুরূহ সংকটের ছবি কি স্পষ্ট হচ্ছে? যে-মানুষটি পাঠাভ্যাস হারিয়ে ফেলছে দ্রুত এবং যার দৈনন্দিনকে শাসন করছে মেকি চিহ্নের সন্ত্রাস—তার কাছে নেতি ও নৈরাজ্যের উদ্ভট প্রতিসন্দর্ভ যোগান দেওয়াই কি সাহিত্যের কাজ? কবিতার হাল-হকিকৎ এই বিভ্রমের পরিসরে সবচেয়ে বেশি কূটাভাসময়। বিকারের ঔদ্ধত্য ও অবিশ্বাসের অহংকার শব্দাবলী থেকে শুষে নিচ্ছে অনুভূতির বর্ণমালা; অভ্যাসের খোলস দিয়ে চালাকির প্রদর্শনী অব্যাহত রাখতে পারলেই হল। অনুভূতি কি সত্য নয় আর? দর্পণে প্রতিবিম্ব নিয়ে খেলছে আজকের খেলনা-মানুষেরা। বিয়োগপর্বের চিন্তাগুরু জী বদ্রিলারকে তাই ভাবতে হয় বিভ্রমের প্রতিজগৎ নয়, ভ্রমকথার চতুর আবর্ত তৈরি করা নিয়ে। সত্য নয় শুধু, মিথ্যাও নির্বাসিত আজ বয়ান থেকে; তাই পাঠকৃতি মানে গোলকধাঁধার সিঁড়ি। বদ্রিলার লেখেন, ‘Today it is events which are neither true nor false and which play with their screens. You can no more isolate an event from its screen than in the past, you could isolate a passion from its mirror.’ (Cool memories: 1994: 65).

 হয়তো এতটুকু নয়; কিন্তু এর কাছাকাছি উচ্চারণ রয়েছে রণজিৎ দাসের কবিতায় (ডায়েরি থেকে ২)) ‘সত্য কী, আমরা জানি না। অথচ মিথ্যাকে জানি, নির্ভুল, নিজের ছায়ার মততা। এই সত্যসন্দিগ্ধ চির জীবনে, মিথ্যাই শেষ পর্যন্ত আমাদের একমাত্র নিঃসংশয় উপলব্ধি, সেই অর্থে আমাদের একমাত্র বিশ্বস্ত সত্য। আমাদের আশ্রয়।...খুব

১৭