সম্ভবত, আমরা মাতৃগর্ভ থেকেই মিথ্যাকে জানি। জিন-এর গৃঢ়তম সন্ধ্যাভাষায় হয়তো ইঙ্গিতবদ্ধ আছে মিথ্যার সংজ্ঞা এবং ব্যবহারবিধি। এই বয়ানে কবি সময়ক্লিষ্ট প্রতিবিম্বের মুখোমুখি যেন। শূন্যতার আনাচে কানাচে কাকতাড়ুয়ার মতো দৃশ্যমান যত বিলীয়মান মুহূর্তগুলি, সেইসব যতখানি ভ্রম ততখানি বাস্তব। ভাষার সপ্রতিভতা সত্ত্বেও চোখে পড়ে প্রচ্ছন্ন হাহাকার। কালবেলায় এই তো অর্জন মান্ধ সভ্যতার। কবিতায় তাই বিষয় খুঁজতে হয় না এখন, ভাবতে হয় না প্রকরণ নিয়েও। আত্মতা ও নৈর্ব্যক্তিকতার পুরনো জলবিভাজনরেখাও অচল হয়ে গেছে। এসময় আলাদা করে কবিতা লিখতে হয় না, প্রতি মুহূর্তের অভিজ্ঞতাপুঞ্জ নিজেরাই কবিতায় বয়ান হয়ে ওঠে। ফলে সংসোজক সূত্রও খুঁজে নিতে হয় না। বিয়োগপর্বের সার্বিক অসংবদ্ধতা ও কেন্দ্রহীনতা নেতির বিন্যাসকেই বয়ান হিসেবে তৈরি করে নেয়। অর্থাৎ প্রতিবাচন লুকিয়ে থাকে বাচনেরই ভেতরে। যেমন রণজিতের ‘টেলি খুশি’ কবিতার প্রথম স্তবক: এক নতুন খুশি এসেছে আমাদের ঘরে। টেলিখুশি। টিভি-র পর্দা থেকে রকমারি পণ্যের চমকদার বিজ্ঞাপনগুলি ঘরময় ছড়িয়ে দিচ্ছে এই অদ্ভুত, রাংতা মোড়া খুশি। যাতে মেশানো আছে স্বপ্ন, মুখোশ, কোকেন, মোহর, ডাইনি এবং আলাদিন। তাই দেখে ঘরের মেয়ে পুরুষদের তো বটেই ঘরের বেড়ালটার পর্যন্ত হাসি হাসি মুখ। কারণ, মূলত নিরানন্দ মানুষের সংসারে, যে-কোনো খুশিই, খুশি।
আধুনিকতাবাদের আরোহী পর্বে জীবনানন্দ লক্ষ করেছিলেন চিহ্নায়কের শৌর্য ও আমোদ; আর, অবরোহী পর্বের সূচনায় তাঁর কবিতায় ব্যক্ত হয়েছিল কার্নিভালের হাসি ও তিক্ত শ্লেষ। আধুনিকতাবাদের প্রচ্ছায়া যখন বাংলা কবিতায় পড়তে শুরু করেছে, অন্তর্দাহ ও স্বগতোক্তি সাবলীল মিশে যাচ্ছে পরিহাস ও কোলাহলে। ভাড়, জ্যোতিষী এবং জহ্লাদ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে একই পঙক্তিতে। ভ্রমকথারই এ এক বিশিষ্ট ধরন। সময়ের বাচন যতক্ষণ কবিদের কাছে ধরা দেয়, প্রতিবাচনের অন্তর্বয়নও মানিয়ে যায়। যেমন জয় গোস্বামী লেখেন “হাসিগুলি, হাহাকারগুলির’ (হাসি, হাসিগুলি, হাসিদের) সমান্তরাল অস্তিত্বের কথা। ক্রমশ বদলে যায় সময়ের অনুভব আর সেই সঙ্গে ‘বারোভাতারী মৃত্তিকার পরিসরকে প্রতিস্পর্ধা জানিয়ে কল্পনাপ্রতিভা হয়ে ওঠে যুগপৎ সুড়ঙ্গসন্ধানী ও মহাকাশচারী। বাস্তব অনায়াসে মিশে যায় প্রকল্পনায়; প্রাগুক্ত আত্মজ্বলন (Self-ignition) ও আত্মসম্মোহন (Self-Seduction) এর উপযোগী পরাবিবরণ প্রতিবেদনে দখলদারি বিস্তার করে, ভাষার চলনও আমূল বদলে যায়:
‘আমরা পান করি, আমরা প্রাণ করি মৃত্যুকে মৃত্যুকে? মৃত্যুকে?
আমরা নিঃশ্বাস ধরেছি, নিঃশ্বাস সৌরবল
আমরা নিঃশ্বাস, আমরা নিঃশ্বাস সীমিত হোম
আমরা আইবুড়ো চাকুরে দিদি তার যুবতী বোন
আমরা ঘরে ঘরে পঙ্গু বাপ আর অন্ধ ভাই
আমরা যা-ই বলি ব্রহ্ম তা-ই কাল ব্রহ্ম তাই বাল ব্রহ্ম তা-ই,
আমরা নিজেদের জায়গা চাই।’