পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 উৎকেন্দ্রিক ও নিরবয়ব সময়ের মধ্যে আজকের কবি-সত্তা দেখতে পায় শুধু খোলা মরণ ফাঁদ’ এবং লক্ষ করে কীভাবে মানুষ স্বয়ং মোড়ে-মোড়ে মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। এসময় শবোথানের; প্রতিসংস্কৃতি ও প্রতিজীবনের জারজ সন্তানেরা সব চর্যচোষ্য সত্য মিথ্যা নির্বিচারে গিলে খাচ্ছে। কিন্তু সর্বব্যাপ্ত মোহিনী আড়াল অনতিক্রম্য বলে সময়ের কৃষ্ণবিবর কারো চোখেই পড়ছে না ‘বিশ্বতানে মোহিছে চুম্বক’। প্রত্যেকের পায়ের তলায় মাটি সরে যাচ্ছে, মাটির তলায় লোহা ফুটছে। অর্থাৎ বাস্তবই প্রকল্পনা হয়ে উঠছে এখন। সমস্ত আবেগ-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা-স্বপ্ন প্রবল ভস্মের মুখে লুটিয়ে পড়ে যখন, প্রতিবাদহীন দিক-ভ্রান্ত মানুষ ওই ভস্মের নিচে লুকোতে যায় আর আমরা সবাই দুই হাতে ভয় ভস্ম খাই।’ (ভুতুম ভগবান)

 কেন সময়ের এই কথকতা তৈরি হচ্ছে আজ? কারণ, বিলুপ্তির আশঙ্কায় ভেতরে ভেতরে ত্রস্ত স্বয়ং কবিতা। সামাজিক মনস্তত্ত্ব জন্ম নেয় বিশেষ আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে। এই সূত্রে বদলে যায় সাহিত্যের অন্তর্বস্তু ও আঙ্গিক, মূল্যবোধ ও অন্বিষ্ট। বাংলা সাহিত্যের পূর্ববর্তী সমস্ত যুগে যা ঘটেছে, এখনো একই প্রক্রিয়ার অভিব্যক্তি দেখছি। তবে কথাটা এইখানে যে এখন মানুষের মৌল পরিসরই আক্রান্ত। তাই ভাষা-চেতনা, সাহিত্য-বোধ সব কিছুই বিপন্ন। আমাদের চোখের সামনেই তো নিঃশব্দে ঝরে যাচ্ছে শৈশব ও কৈশোরের সারল্য, লাবণ্য ও নিবিড়তা। সহজ পাঠের সহজ আনন্দ এখন নির্মমভাবে নির্বাসিত। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের অন্ধ প্রতিযোগিতায়, উৎপাদিত চিহ্নের সন্ত্রাসে আর ভোগ্যপণ্যের মাদকতায় কালো হয়ে গেছে আমাদের আকাশ। শিক্ষা-ব্যবস্থায় কেবল প্রকরণ রূপান্তরিত হয়নি, নির্যাসও অন্তর্হিত। আমাদের সংস্কৃতির শেকড় উপড়ে ফেলছে বিশ্বপুঁজিবাদ। আর, সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করার জন্যে দ্রুত ধেয়ে আসছে প্রযুক্তি-সেবিত সামন্তবাদের অন্ধকার। রাষ্ট্রীয় প্রতাপের আনুকূল্যে আসমুদ্র হিমাচল এক ছাঁচে ঢালাই হয়ে যাচ্ছে। বাঙালি কবি-লিখিয়েরা জারজ-সংস্কৃতির প্রশ্রয়দাতা রাজনীতির কৃষ্ণবিবরকে শনাক্ত করতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতেই তীব্র আত্মবিদারক শ্লেষে জয় লেখেন, আমরা সব বুদু সব ভূতুম ভগবান। এই সময়ের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সত্য, মিথ্যা, সন্দর্ভ, প্রতিসন্দর্ভ, প্রতিবেদন, ভ্রমকথা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস—সব কিছু একাকার হয়ে যাওয়া আর সব কিছু সহনীয় হয়ে যাওয়া। কিছুদিন আগেও কবি-লিখিয়েরা প্রতিবাদ করতেন, প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন কেননা কোনো-না-কোনো ভাবে দায়বোধ পীড়িত করত তাদের। কিন্তু এখন নির্লিপ্ততা ও উদ্বেগহীনতা নৈরাজ্যকেই দার্শনিক সমর্থন দিয়ে যায়। এমন কী কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্ধতা এত সর্বগ্রাসী যে পৌরসমাজ আর রাজনৈতিক সমাজের পশ্চাৎগতিও তাদের কোথাও সংলগ্ন করে তোলে না। বরং আধিপত্যবাদীদের চতুর কৃৎকৌশল সম্পর্কে উদাসীন থেকে তারা অনায়াসে প্রতিগতির শিবিরে যোগ দিতে পারেন। এখনকার বয়ানে তাই আত্মপ্রতারক মোহিনী আড়াল অতি সহজেই বিমানবায়ন প্রক্রিয়ার পালে হাওয়া দিচ্ছে।

 আমরা কি লক্ষ করেছি প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের বিজ্ঞাপনে কত সাবলীল ভাবে

১৯