পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ‘কোথাও আঘাত ছাড়া অগ্রসর সূর্যালোক নেই’-জীবনানন্দের এই গহন উপলব্ধি হয়েছিল অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদের আগ্রাসী চোরাবালি লক্ষ করে। আমিষ অন্ধকারে কত শত সূর্যকে ডুবে যেতে দেখেছিলেন তিনি, ক্লান্ত পৃথিবীর বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে তার চোখে পড়েছিল শতশত শূকরীর প্রসব-বেদনার আড়ম্বর। জীবনের অন্তর্নিহিত দ্বিবাচনিকতা পুনরাবিষ্কারে ও পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন। আলো যে গভীরতর হয় অন্ধকারে এবং মানুষের মৃত্যু হলেও মানব বেঁচে থাকে—অলঙ্ এই সত্য তার উচ্চারণে ফিরে ফিরে এসেছে তাই। আধুনিকোত্তর পর্যায়ের ক্রমবর্ধমান গ্লানির আত্মবিদারক হাহাকারে দীর্ণ হতে হতে পুনঃপাঠ করতে পারি জীবনানন্দের সময়মনকেও। নিশ্চিত খুঁজে পাব আমরা অম্লান বিশল্যকরণী। দেখব, হাজারবার ইতিহাসকে মৃত বলে ঘোষণা করলেও তা তথ্যের কঙ্কালমাত্র নয়। এখনো ইতিহাস খুঁড়লে পাওয়া যায় শত শত জলঝর্নার ধ্বনি, উত্তরায়ণ মনস্কতার সংকেত। জীবনানন্দ যে উত্তর-ব্যক্তিসত্তার কথা বলেছিলেন, এখনই তো তার যথার্থ তাৎপর্য ও গঠনশৈলী আবিষ্কার করার সময়। শুধু দ্রষ্টা চক্ষু চাই আজ। তেমন চোখ যা শুধু তাকিয়ে থাকার জন্যে নয়, দেখার জন্যে। হয়তো তখন অনেক অদৃশ্য পর্দা সরে যাবে। অতিপরিচয়ের অভ্যস্ততা যে কুয়াশার আড়াল তৈরি করে, তা সরিয়ে দিয়ে পুরনো মুখের মধ্য থেকে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে নতুন অবয়ব। নতুন সত্য, নতুন উপলব্ধি। দেখব, উত্তর-ব্যক্তিসত্তার প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের খুব কাছাকাছি। বুঝব, সংস্কৃতি জীবন সংগঠক, উন্মোচন ও প্রসারণ তার স্বভাবধর্ম।

 অবস্থানগত যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ করে কোনো-এক হরিমাধব মুখোপাধ্যায় যখন বালুরঘাটে ত্রিতীর্থের মতো অসামান্য লড়াকু নাট্যগোষ্ঠী তৈরি করেন কিংবা ওই একই শহরে অজিতেশ ভট্টাচার্য ৩৪ বছর ধরে মধুপণীর মতো সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেন তারা নিশ্চয় উত্তর-ব্যক্তিসত্তার প্রতিভূ হিসেবে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেন। তেমনি বরাক উপত্যকার সবচেয়ে পশ্চাৎপদ শহর হাইলাকান্দিতে বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের ‘সাহিত্য’ তিন দশকব্যাপী যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে চিহ্নয়কে রূপান্তরিত হয়। বাঙালির বিভিন্ন জনপদে সমীরণ মজুমদার, অখিল দত্ত, দেবব্রত দেব, উত্তম দাশ, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সরকার আশরাফ, ফারুক সিদ্দিকী, বিভাস চক্রবর্তী, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত, অঞ্জন সেন, হাসান আজিজুল হকেরা প্রমাণ করছেন, অনেকান্তিক মৃত্যু-উপত্যকায় পারাপারহীন সন্ধ্যা নেমে এলেও মানুষ অপরাজেয়। ইতিহাস ও সভ্যতা যতই পুড়ে যাক, উত্তরব্যক্তিসত্তা অজর অক্ষয়। এইজন্যে শিলচরের মতো প্রান্তিক জনপদেও আমাদের উদ্যোগহীন স্বপ্নহীন সংকল্পহীন মেকি অস্তিত্বের স্থবিরতাকে সমূহ লজ্জিত করে ৭২ বছরের চিরতরুণ মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য শরীরের প্রতিটি বিভঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন নাচের ললিত ছন্দ। ধ্রুপদী ও লোকায়ত শিল্প-ভাবনার সুষম সমন্বয়ে তার প্রতিটি সঞ্চালনে প্রতি মুদ্রায় নাচ নয়, আসলে জীবনের অফুরান সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা পুষ্পিত হয়ে ওঠে। অবক্ষয়বাদের সমস্ত কৃৎকৌশলকে পরাভূত করে মুকুন্দদাস আমাদের ফিরিয়ে দেন যেন জীবনকে নতুনভাবে ভালোবাসার জোর, বিশ্বাসের শক্তি,

২৭