পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দিয়ে ঢুকে পড়ছে অসমিয়া। এই মুহূর্তে বরাক উপত্যকায় আধা-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত দুবছর ধরে ২৫ বৈশাখ উদ্যাপনে বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছে প্রশাসন। এদের স্পর্ধা দিনদিন বাড়ছে। যেভাবে বঙ্গভাষাভাষী গোয়ালপাড়া জেলাতে ভাষিক সম্প্রসারণবাদীরা অসমিয়াকরণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে ফেলেছে, তেমনি ওদের আগ্রাসন ইদানীং শুরু হয়েছে বরাক উপত্যকায়। ইতিহাসের নিয়মে যা ঘটে থাকে, ট্রয়ের ঘোড়া তৈরি হয়ে গেছে অনেক। তৈরি হয়ে গেছে ফেউয়ের গোষ্ঠী, ভাড়াটে কলমচি আর উচ্ছিষ্টজীবীর দল। একদিকে অসমিয়াকরণের জাল, অন্যদিকে নিকৃষ্ট হিন্দিয়ানির চাপ। তাছাড়া সব কিছুর উপরে রয়েছে বিশ্বায়নের মাদক। অসংখ্য চ্যানেল দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বিবেকশূন্য ভোগবাদের নীলস্বপ্ন। ভাষা-সংগ্রামের উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে উঠেছিল বরাক উপত্যকায় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এক দশকেরও বেশি লড়াইয়ের পরে ১৯৯৪ সালের ২১ জানুয়ারি যদিবা জন্ম দেখলাম তার, ঐতিহ্যবিচ্যুত আত্মবিস্মৃত প্রজন্ম ভুলে যেতে বসেছে এই ঘটনার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে শোনা যায়, বাঙালি ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে ফিল্মি হিন্দিতে বা ইংরেজিতে। চারদিকে শুধু ধূসর রিক্ততার ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়, জীবনানন্দের অনুপম ত্রিবেদী আর সুবিনয় মুস্তাফীরা বাঙালির তৃতীয় ভুবনের গভীর-গভীরতর অসুখের সূত্রে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এখনই।

 বিশ শতকের বাঙালির অর্জন কি তাহলে নেতিবাদ ও আত্ম-নিরাকরণের বিস্তার? ১৯৪৭ সালে আমরা তো বাঙালি পরিচয়ে দাঁড়াতে চাইনি, দাঁড়িয়েছি হিন্দু ও মুসলমানের পরিচয়ে। আত্মপ্রতারণার শুরুও হল তখন। ভারতবর্ষ মানে হিন্দুদের বাসভূমি, একথা ঔপনিবেশিক ন্যায় অনুযায়ী মেনে নেওয়ার পরে বাঙালি ও ভারতীয় এই দুই অভিজ্ঞানের গৌরবই অনেকটা অস্তমিত হল নাকি? এর পরে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা অবিরাম করলাম বটে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর থলে থেকে বেড়াল তো বেরিয়ে পড়ল। অন্তত কিছুদিনের জন্যে হলেও, বিভ্রান্ত ভারতবর্ষের অন্য অঞ্চলের মতো, বাঙালির ভুবনেও তো কালো ছায়া পড়েছিল ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’র। কোথায় থাকল তখন আলাওল-নজরুল-ওয়ালীউল্লাহ-শহীদুল্লাহের উত্তরাধিকার? এর পরে বারো বছর যেমন গোটা ভারতবর্ষের জন্যে অন্ধকারে পিছলে যাওয়ার সময়, তেমনি বাঙালির পক্ষেও খুব উজ্জ্বল নয়। বিশেষত তৃতীয় ভুবনের অস্তেবাসী বাঙালিদের ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত জটিলতার জন্যে এসময় আত্ম-নিরাকরণের, ভেসে যাওয়ার। কেননা বাঙালি ভুলে যেতে বসেছে কোথায় তার সাংস্কৃতিক গৌরবের মূল কারণগুলি নিহিত। বরং, বাঙালিত্ব মুছে নিয়ে প্রাণপণে হয়ে উঠেছে। আর্যাবর্তের পিছিয়ে-পড়া ভাবনার কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের স্বদেশ-ভোলানো শেকড়-উপড়ানো চিন্তার লেজুড়। গত কয়েক বছরে ঘড়ির কাটাকে উল্টো পাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটি প্রান্তিক অঞ্চলে চোখে পড়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে শনি মন্দির প্রতিষ্ঠা, ধর্মগুরুদের উৎকট বিজ্ঞাপন-মুখর উৎসবের আয়োজন, অন্যদিকে

৩২