পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মসজিদে-মোক্তবে বিচিত্র সব প্রচারকদের হঠাৎ বেড়ে-যাওয়া আনাগোনা। যাঁরা কিছুদিন আগেও শুধু বাঙালি ছিলেন, এখন তারা নিজেদের জুড়ে দিচ্ছেন হিন্দুস্রোতে কিংবা মুসলমানস্রোতে। এবং, এঁদেরই ঘরের ছেলেমেয়েরা ভর্তি হচ্ছে সাহেবি কেতার ইশকুলে। শিখছে কুইজ, শিখছে অত্যাক্ষরী। কিন্তু কেউ মাতৃভাষা শিখছে না। মা-বাবারা এদের তাড়না করছেন সব কিছুতেই প্রথম হওয়ার জন্যে। যে-কোনো মূল্যে সাফল্য চাই। এদের মানসিকতা জুড়ে প্রতিযোগিতা, অসহিষ্ণুতা, ঈর্ষা; সহযোগিতা, সহমর্মিতা, মানিয়ে নেওয়া, মান্যতা ইত্যাদি এদের কাছে হয়ে উঠছে জীবনের পক্ষে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক আভিধানিক শব্দমাত্র। এরা যে বাংলা লিখতে পড়তে জানে না, এজন্যে অপরাধবোধ দূরে থাক, ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত নেই। এরা টিভির চ্যানেলে-চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায়, মা-বাবার উপস্থিতিকে তোয়াক্কা না করে শরীরী মাদকের অমৃতফল খায়। এদের কোনো পক্ষীরাজ ঘোড়া বা বেঙ্গমা বেঙ্গমী নেই, আছে কেবল ভিডিও গেম বা কম্পিউটারের ইন্দ্রজাল। মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-জীবনানন্দ নজরুল-সত্যজিৎ রায়-ঋত্বিক ঘটক-ওয়ালীউল্লাহ-ইলিয়াস-জয়নাল আবেদিনদের নিয়ে বিশ শতকের প্রত্নবস্তু হিসেবে রুদ্ধ হয়ে যাবে বাঙালির পরিচয়। একুশ শতকে কম্পিউটারইণ্টারনেট-উপগ্রহ-প্রযুক্তির চক্রব্যুহে স্বেচ্ছাবন্দী প্রজন্মগুলি আর যা-ই হোক বাঙালি থাকবে না। কিন্তু গণেশ দুধ খেতে থাকবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, মোল্লাতন্ত্র জাঁকিয়ে বসবে আরও। এইসব সাধারণ সত্যের অতিরিক্ত বিশেষ কিছু সত্য রয়েছে উত্তরপূর্ব ভারতের প্রান্তিকায়িত বাঙালির জন্যে। তাদের পায়ের নিচে শক্ত জমি নেই, চোরাবালি আছে। আঞ্চলিক উপনিবেশবাদের কাছে স্বেচ্ছাসমর্পিত হওয়াতে ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছে শিরদাঁড়া আর পায়ের নিচে অনবরত ঝুরঝুর করে সরে যাচ্ছে বালি।

 প্রতিটি আগামীকালই তাই হয়ে উঠছে আরও একটু পঙ্গু, আরও একটু বিকৃত আগামীকাল। যেখানে বারুদ থাকার কথা ছিল, সেখানে শুধু পুঞ্জ পুঞ্জ ছাই। এই ছাই এমন যার তলায় ধিকি ধিকি আগুনের আঁচ নেই কোনো। নির্ভেজাল ধূসর ও কালো আখরে সময় লিখে চলেছে রূপহীন চরিত্রহীন কৃষ্ণবিবরের কথকতা। বাঙালির তৃতীয় ভুবনে যদিও সাহিত্য-সংস্কৃতির টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এখনো, লক্ষ্যশূন্য তাৎপর্যশূন্য উদ্যমের ফলে ওই আলোকেও গিলে খেতে চাইছে ছায়া ও প্রচ্ছায়া। রূপকের ভাষা এসে গেল বটে, কিন্তু আসলে এ ঘোর বাস্তব। প্রান্তিকায়িত বাঙালি সত্তা সমান্তরাল অপরতার মধ্যে সৃষ্টির উত্তাপসূত্র খুঁজে নেওয়ার পদ্ধতি ও প্রকরণ ভুলে যেতে বসেছে। ছোট পত্রিকাগুলি হয় মৃত নয়তো অর্ধমৃত। ব্যক্তিগত উদ্যমের পুঁজি কিছুতেই সামূহিক উদ্যমের সম্পদে রূপান্তরিত হচ্ছে না। তার ওপর নেই উদ্যমের ধারাবাহিকতা, নেই তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্পর্কে গভীর কোনো উপলব্ধি। এক দশকের অনেক আগেই ভেঙে যাচ্ছে সংঘ, তেল ফুরিয়ে যাওয়ার আগে ঝরে পড়ছে সলতে। ফলে সস্তায় বাজিমাত করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিপুল ও অবিভাজ্য বাঙালি সত্তার সাংস্কৃতিক আয়তনে নিজস্ব বৈচিত্র্য ও জীবনানুভবকে প্রতিষ্ঠিত করার জরুরি কাজ উপেক্ষা করে এক ধরনের ভুল আঞ্চলিকতার

৩৩