পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পৃথিবীতে মার্কিনী গুণ্ডামি যেভাবে দেখা গেছে, তা সমস্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশের পক্ষে ভয়ানক বিপদের কথা। সোভিয়েট রাশিয়া যতদিন ছিল, নেকড়ে ও শকুনেরা এত দুঃসাহসী হয়ে ওঠেনি। গত কুড়ি বছরে এরা প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের উস্কানি দিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। গণতন্ত্র-স্বাধিকার-প্রগতি বারবার ধর্ষিত হয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিশ্বায়নের ফাস। দখলদারির রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ বিশ শতকের শেষ কয়েকটি বছরে নিরঙ্কুশ হয়ে পড়েছে। আফগানিস্তানে ওসামা-বিন-লাদেন ও তালিবান তো মার্কিনীদের অপসৃষ্টি; পরে হাত থেকে আম বড়ো হয়ে গেল যখন, বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেণ্টাগন আক্রান্ত হল। এমন না ঘটলেও আফগানিস্তানকে ওরা ছারখার করতই। কারণ, ভূ-রাজনীতি ও তেল-অর্থনীতির বাধ্যবাধকতা। বিশ্ববিবেক যখন রাষ্ট্রীয় প্রশাসকদের হাতে জিম্মা থাকে, লাখে-লাখে মানুষ মরলেও কাগুজে বিবৃতি আর কূটনীতির প্যাচ-পয়জার ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায়। সাধারণ মানুষের কাছে, দেশে-দেশে, গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রযন্ত্র অবান্তর ও ভড়দের মহাসভা বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। উপগ্রহ-প্রযুক্তির ওপর দখলদারির সুযোগে বার্তাবাহী চ্যানেলগুলিকে সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে পাইক-বরকন্দাজে পরিণত করেছে, সংবেদনশীল মানুষেরা এদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।

 ইরাক-যুদ্ধে ইণ্টারনেটের ওপর শকুনের ছায়া পড়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু বেয়াদব ওয়েবসাইটকে হয় মুছে দিয়েছে প্রভুত্ববাদীরা নয়তো এদের বিকৃত করেছে। তবু, বিকল্প সংবাদ বিকল্প বক্তব্য বিকল্প অবস্থান খুঁজে নেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী নিজেদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ঘোষণা করছেন। ইণ্টারনেটকে সদর্থক ভাবে কাজে লাগাতে না পারলে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে লাখ-লাখ মানুষ জমায়েত হতে পারতেন না। কালো জিউলানি শহিদ হতেন না; ইরাকে প্রসূতিসদন, গ্রন্থাগার ও প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হানার পরে লুঠতরাজের খবরও আমাদের কাছে পৌঁছাত না। একুশ শতক যদি আফগানিস্তান ও ইরাক ধর্ষণের কালো ছবি দিয়ে শুরু হয়ে থাকে, তা ইতিহাসের সম্ভাব্য নতুন অধ্যায় সূচনার প্রতি তো তর্জনি সংকেত করছে। এই অধ্যায়ে একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্র, অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক জনগণের যুক্তফ্রণ্ট। যতদিন যাবে, এই প্রধান দ্বন্দ্ব আরও ব্যাপক ও শানিত হয়ে উঠবে। অন্তত এখনকার সংস্কৃতিকর্মী ও সমাজকর্মীদের ন্যূনতম ও প্রধানতম দায় বলে বিবেচিত হোক এই দ্বন্দ্বকে সচেতন ভাবে ব্যাপকতর ও শানিততর করে তোলা।

 হাতির গোদা পায়ের নিচে পিঁপড়ের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াকে যেসব মতলববাজেরা ‘যুদ্ধ’ বলে সম্রান্ত করতে চায়, ওদের ধারণা, এভাবেই ওরা দুনিয়ার তাবৎ বোকাসোকা ললাকেদের চোখে ঠুলি পরাতে পারবে। অন্তত, শয়তানি সাম্রাজ্যের শাহানশাহ বুশ ভয় দেখাতে পেরেছে তাদের যারা তাকে কুর্নিশ করে না, তার কথামতো ঘুঙুর পরে নাচে এবং হিজড়ে ও বিদূষক সাজে না। কেননা এই উদ্ধত দানবটি মাত্র কিছুদিন আগে, হিটলার মুসোলিনীর কায়দায় চোখ রাঙিয়ে বলেছিল, যারা আমেরিকার সঙ্গে নেই,

৪৬