পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আসামের বরাক উপত্যকা ভাষাশহিদদের পবিত্র ভূমি। আর, রাজনৈতিক ইতিহাসের চক্রান্তে মূল বঙ্গভূমি থেকে বহিষ্কৃত ও দূরবর্তী হলেও এবং যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সিলেটি উপভাষা ব্যবহৃত হলেও, এরা শতকরা একশ’ ভাগ বাঙালি। নোয়াখালি-চট্টগ্রামের উপভাষা সবাই যেমন বুঝতে পারেন না (তেমনি বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার উপভাষাও), সিলেটিও তা-ই। কিন্তু উপভাষার এত বিপুল সমৃদ্ধি বাংলা ভাষারই গৌরব: এই মৌলিক কথা কলকাতার মহানাগরিক গ্রাম্যতায় বন্দী অনেক বাঙালি আজও অনুধাবন করেন না।

 এক অদ্ভূত লড়াই আছে বরাক উপত্যকার বাঙালিদের জন্যে। সিলেটি উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক প্রভাবে মান্য চলিত ভাষা উচ্চারণে বেশ কিছুটা বৈচিত্র্য এসে যায়। অভিজ্ঞ কানে কিন্তু বীরভূম-কোচবিহার-মালদহ কিম্বা খুলনা-পাবনা-রংপুরের উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্য ঠিক ধরা পড়ে। এইজন্যে অন্যান্য অঞ্চলের বাঙালিদের যদি আত্ম-পরিচয় ঝাপসা না হয় তাহলে এখানকার মানুষদের কেন ‘বাঙালি’ বলে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে? এই প্রমাণ অন্য কোথাও পেশ করতে হয় না, কলকাতার কূপমণ্ডুক সাংস্কৃতির মনসবদারদের কাছে করতে হয়। এ যে কত বড়ো অপমান ও বেদনার বিষয়, তা শুধু বরাক উপত্যকার বাঙালিরাই বোঝেন। অথচ কলকাতার কাছে বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্ব তো পড়ে-পাওয়া চোদ্দ আনা মাত্র। ঘরে-বাইরে আক্রান্ত বাংলা ও বাঙালির জন্যে সামান্য সচেতনতাও কোথাও আছে বলে মনে হয় না। বস্তুত এই মুহূর্তে সাহিত্য ও সংস্কৃতির পতাকা যাঁদের শক্ত মুঠোয় ধরা রয়েছে, তারা কেউ প্রতিষ্ঠানের সেবাদাস নন। কিন্তু সে-কথা এখানে নয়। কোন বেদনায়-অভিমানে-ক্ষোভে বরাকের বাঙালি কবি দিলীপ কান্তি লস্করকে লিখতে হয় এরকম, বরং সেদিকে লক্ষ করা যাক:

‘আমি কোথেকে এসেছি, তার জবাবে যখন বললাম:
করিমগঞ্জ, আসাম;
তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন: বাঃ বেশ সুন্দর
বাংলা বলছেন তো!
একজন শিক্ষিত তথা সাহিত্যিকের যখন এই ধারণা, তখন
আমি আর কী বলতে পারি।
ওঁকে ঠিক জায়গাটা ধরিয়ে দিতে গিয়ে বললাম:
বাংলা ভাষার তেরো শহিদের ভূমিতে আমার বাস।
তখন তিনি একেবারে আক্ষরিক অর্থেই আমাকে ভির্মি
খাইয়ে দিয়ে বললেন:
ও! বাংলাদেশ? তাই বলুন।
সম্প্রতি ‘দেশে’ সুনন্দ সান্যাল, তার মাতৃভাষা বিজ্ঞানের প্রবন্ধে বললেন:
‘আমাদের বহুভাষী দেশে রক্তমূল্যে মাতৃভাষা চেনার
ঘটনা ঘটেনি।’

৬১