পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

উপত্যকার সৃষ্টিশীল মন অপর পরিসরের সত্তাতাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকল্প দিয়েই লিখনবিশ্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা আর বিকল্প বয়ান বিকল্প বীক্ষণ এই চেষ্টার মৌল চালিকাশক্তি। আধিপত্যবাদী ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা জানাতেই লেখা, বেঁচে থাকা, হয়ে ওঠা। বাংলার, বাঙালির অতি উদ্ভাসিত অবয়ব যে কুহকমাত্র, এই জেনে সেই কুহক নিরাকরণ করতে লেখেন শক্তিপদ, শেখর। যতক্ষণ এই সত্য জানতে পারছি না, ততক্ষণ কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের মরীচিকায় বুদ হয়ে থাকছি। চিত্রভানু ভৌমিক, শেখর দেবরায়, প্রদীপ নাথ, দেবব্রত চৌধুরী, আশুতোষ দাস-এর মতো নাট্যকার এই বরাক উপত্যকার জীবনে ব্যাপ্ত বিচিত্র লীলাভঙ্গ থেকে অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদের বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর বয়ান খুঁজে নিচ্ছেন—এও কম তাৎপর্যবহ নয়। প্রতীচ্যের আধুনিকোত্তর প্রবণতার উল্টো মেরুতে গিয়ে আবহমান দেশজ সংস্কৃতির জমিতে উত্তরায়ণমনস্ক উত্তর আধুনিক চেতনার বিশল্যকরণী নিয়ে আসছেন যাঁরা নাট্যপাঠকৃতিতে, তাদের সঙ্গে চিত্রভানুদের আত্মীয়তা এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

 তুলনামূলক ভাবে প্রবন্ধে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে বরাক উপত্যকা। সুজিৎ চৌধুরী, অমলেন্দু ভট্টাচার্য, সঞ্জীব দেবলস্কর: সামগ্রিক প্রেক্ষিতের নিরিখে এই তিনজন উল্লেখনীয় কেবল। কেননা সাধারণ আলোচনা আর প্রবন্ধ এক কথা নয়—এ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এখনও প্রকট। অবশ্য এটা কেবল বরাক উপত্যকার বিশেষত্ব নয়; সাধারণ ভাবে সমগ্র বাংলা সাহিত্য এবং ছোট পত্রিকার অণুবিশ্বও একই দোষে ভুগছে। পিটুলিগোলা জল আর দুধ একাকার হয়ে যাচ্ছে প্রায় সর্বত্র। প্রবন্ধ লেখার জন্যে যে দীর্ঘমেয়াদি অধ্যবসায়, ধৈর্য, পরিশ্রম ও অন্তর্দীপ্ত বিশ্লেষণ-নৈপুণ্য চাই, তা একদিনে তৈরি হয় না। তাছাড়া চাই বিকল্প ভাববিশ্ব ও বিকল্প বয়নপদ্ধতি সম্পর্কে গভীর মননজাত প্রস্তুতি। অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনার ক্রমিক উন্মোচন যেখানে প্রত্যাশিত, সেই ছোট পত্রিকাই শমীগর্ভে আগুন ধারণ করতে পারে। বরাক উপত্যকায় ছোট পত্রিকার ধারাবাহিক প্রকাশনা না-থাকার ফলেই সম্ভাব্য প্রাবন্ধিকদের দেখা মেলে নি।

 এবার ফিরে যেতে পারি বিজিৎকুমারের প্রাগুক্ত প্রবন্ধে। তিনি নতুন সাহিত্য-চিন্তা, আদর্শগত প্রতিজ্ঞা ও সৃষ্টিধর্মী তন্নিষ্ঠ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। ছোট পত্রিকার লেখকদের এইসব অভিজ্ঞান ছাব্বিশ বছর আগে যতখানি সত্য ছিল, এখনও ততটুকু সত্য। বিজিৎ লিখেছেন: ‘লিটিল ম্যাগাজিনগুলোর জন্ম হয় কোনো একটা আদর্শগত প্রতিজ্ঞা নিয়ে, সমাজ সচেতনতা নিয়ে ভাঙচুর, বিদ্রোহ, আন্দোলন—মোট কথা সাহিত্যে একটা নতুন ভাবনা চিন্তা নিয়ে আসা, একটা সর্বাঙ্গীণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রকাশিত হয় লিটিল ম্যাগাজিনগুলো। এদের পাঠক নির্বাচিত এবং প্রাপ্তবয়স্ক। সুতরাং আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ, বেঁচে থাকা অনিশ্চিত, অকালমৃত্যুর হার খুব বেশি। তবু একটার পর একটা জন্ম চলছেই নতুন সাহিত্য-ভাবনা নিয়ে, রিলে রেসের মতো এক হাত থেকে অন্য হাত হয়ে এগিয়ে চলেছে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের যা কিছু গৌরবের ধন।’ ওই শেষের কথাতেই রয়েছে অপর পরিসরের লিখনবিশ্বের

৬৮