পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাঙালিত্ব ও বাংলা ভাষা কোনঠাসা। তার ওপর রয়েছে ইংরেজি-মাধ্যম পাঠশালাগুলির মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে-পড়া মেকি সাহেবিয়ানার দৌরাত্ম্য। ইংরেজি তো নিশ্চয় শিখব আমরা। কিন্তু হীনমন্যতা নিয়ে বাঙালিরা ইংরেজিয়ানার পেছনে ছুটেছেন, তাতে বকচ্ছপ ও হাঁসজারুদের সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে শুধু। শৈশব জুড়ে এখন হরেক রকম কমিকস, কৈশোরে টিন-এজারদের রোমাণ্টিক অ্যাডভেঞ্চার, আর যৌবনে যৌনতা ও হিংস্রতার ককটেল। এটা অবশ্যই সর্বভারতীয় সমস্যা; কিন্তু আত্মবিস্মৃতির চক্রব্যুহে বন্দী বাঙালির জন্যে তা বিশেষ সমস্যাও বটে। বিশ শতকে দেশ স্বাধীন হল, বিচিত্র কূটাভাসে স্বাধীনতার মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে গেল তবু তারা ভারতীয়তার নির্মাণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু ‘আরণ্যক’ এর সেই স্মরণীয় বাক্যটি ফিরে ফিরে আসে: ভারতবর্ষ কোন দিকে? পচা গলা সামন্ততন্ত্র যেখানে জাতপাতধর্মান্ধতা-কুসংস্কারের অন্ধকূপ তৈরি করে রেখেছে, যেখানে হরিজন পোড়ানোর মোচ্ছব চলে,সতীদাহ প্রথা পায় রাষ্ট্রীয় প্রতাপের সমর্থন, নির্বাচনী ঢাকেকাঠি পড়া মাত্র ধর্মীয় উন্মাদনার জিগির তোলা হয়—তা-ই তো প্রকট ভারতবর্ষ। কেননা সংখ্যার জোরে এই শক্তি ইন্দ্রপ্রস্থে রাজপাট সামলায় এবং তাদের রুচি ও সংস্কৃতি মাফিক জাতীয় সংহতির বুলি কপচায়। এই ভারতীয়তায় দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবে’ নেই; মাৎস্যন্যায় আছে শুধু। চৈতন্য-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-লালন যে ভারতবর্ষের নির্মাতা, বাঙালি তো তারই উত্তরাধিকারী। সাম্প্রতিক ইণ্টারনেট আর ই-মেলের জমানাকে আধিপত্যবাদীরা ব্যবহার করে গণেশের দুধ খাওয়ার বৃত্তান্ত আসমুদ্র হিমাচলে ছড়িয়ে দিতে। উপগ্রহ-প্রযুক্তিকে কাজে লাগায় অহরহ মধ্যযুগীয় অপচেতনাক বিনোদনের মোড়কে পরিবেশন করার জন্যে। এই ভারতীয়তার নির্মাণই তো হচ্ছে অষ্টপ্রহর। ইংরেজি পড়ে নানা ধরনের প্রযুক্তিতে যত কৃতবিদ্যই তোক এখনকার প্রজন্ম, বিশ্বায়িত ভোগবাদের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও বিকল্পই নেই তাদের। সুকুমার-উপেন্দ্রকিশোর কিংবা রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র, নজরুল-জীবনানন্দ, অবনীন্দ্র-সুলতান, কমলকুমার-ইলিয়াস যে বহুস্বরিক বাঙালিত্বের স্থপতি—তার তাৎপর্য অনুশীলনের তাগিদ দিন দিন কমে আসছে।

 তবু এই দুস্তর মরুই শেষ কথা হতে পারে না। চলমান ইতিহাসের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন থাকে দ্বিরালাপের সম্ভাবনা, পুনর্নির্মাণের আর্তি। শুধু তাকে খুঁজে নিতে হয়। বিশ শতকের অন্তিম প্রহরে যেমন দেখা গেছে নবজাগরণের উদ্যম, শুধু চিন্তাবিত্তে ঋদ্ধ হওয়ার জন্যে নয়-বাস্তব পরিসরে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্যেও। আপনার গন্ধে আপনি বিভোর বৌদ্ধিক বর্গীয় কস্তুরীমৃগেরা থাকুন একান্ত নিজস্ব চারণভূমিতে; বহুধাবিচ্ছিন্ন সাধারণ বাঙালির কাছে জীবনচর্যা ও মননবিশ্বের নতুন স্থাপত্য-সম্ভাবনার বার্তা যদি পৌছে দেওয়া যায়—নবজাগরণ বাস্তবায়িত হবে নিশ্চয়। ঐতিহ্য ও বর্তমানের দ্বিবাচনিকতা সম্পর্কে এখনও সংশয় রয়েছে; নানা ভুবনের বাঙালির বিচিত্র জটিল সমস্যা এখনও অভিনিবেশের বিষয় হয়নি। হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব নামক মহাসন্দর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার মতো আকরণোত্তর বিন্যাস এখনও আধুনিকোত্তর পর্যায় সত্ত্বেও

৭৭