কখনও এড়িয়ে চলি। বাংলা ভাষার আশ্চর্য স্থিতিস্থাপকতা যেভাবে গড়ে উঠেছে, তারও যথার্থ অনুশীলন করিনি আমরা। করলে হয়তো ওইসব অন্ধবিন্দু থেকে অন্তদৃষ্টির উদ্ভাসনে পৌছানো যেত। সমাজ-ভাষাতত্ত্ব বা ভাষামনস্তত্ত্ব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই এইজন্যে। দরকার বাঙালিত্ব সম্পর্কে অনুভূতির, বাঙালি হয়ে ওঠার দীর্ঘ ও উচ্চাবচতাময় ইতিহাসের তাৎপর্য বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী নিজেদের গড়ে তোলার। চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, রাম পাঁচালী, ইউসুফ জুলেখা হয়ে রবীন্দ্রনাথ, লালন, মহাশ্বেতা, ইলিয়াসে বহমান ভাষাচেতনা স্বভাবে দ্বিবাচনিক ও অনেকান্তিক। নাগরিক বৈদগ্ধ্য ও গ্রামীন সজীবতায় বারবার যে বহুবাচনিক আদল ফুটে ওঠে, তাকে কোনো একটি নির্দিষ্ট নিরিখে ব্যাখ্যা করতে চাইলে মৌলবাদী ভাবনায় খপ্পরে গিয়ে পড়ব। হিন্দু ও মুসলমান, শহুরে ও লোকায়ত বর্গ মিলে একটাই ভাষাবিশ্ব বাঙালির। কয়েকটি শব্দ বা বাগবিধির প্রয়োগ বা অপ্রয়োগ হয়তো ভাষা-ব্যবহারের হিন্দুয়ানি বা মুসলমানি নির্দেশ করে। কিন্তু সমাজভাষাতাত্ত্বিক এইসব চিহ্নায়কের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করলে ভুলে যাব লোকায়ত মনীষার এই দির্শক উচ্চারণ: ‘নানান বরণ গাভীরে ভাই/একই বরণ দুধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকে মনে হয়, বাঙালির ভাষাপরিমণ্ডলে কোথাও নিম্নচাপ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। দমকা হাওয়ার দু-তিনটে ঝাপটা টের পাচ্ছি, হয়তো ঝড় উঠবে কিংবা তার আগেই দুর্যোগের ভিন্ন একটি রূপ দেখতে পাব আমরা। একদিকে বিশ্বায়নের নামে আধিপত্যবাদী সমগ্রায়ন অর্থাৎ তথ্য-বিনোদন প্রযুক্তির সর্বাত্মক সন্ত্রাসে বাঙালির ভাষাচেতনার বৈশিষ্ট্য ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে লোকায়ত পরিসরকে প্রান্তিকায়িত করে বকচ্ছপ ও হাঁসজারু প্রতিভাষাদের রমরমা দিনদিন নির্বাধ হয়ে উঠছে।
হ্যাঁ, এটা শুধু বাংলা ভাষারই সমস্যা নয়। কিন্তু তবু আমাদের বিশেষ ভাবে চিন্তিত হতে হচ্ছে এইজন্যে যে কোনো আসন্ন বা চলমান যুদ্ধ থেকে অন্য কারও ভরসায় সরে থাকা যায় না। অন্য ভাষাভাষীদের একই যুদ্ধ হয়তো, কিন্তু তাদের যুদ্ধ থাকুন, আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে, কোনো অজুহাতেই তা মুলতুবি রাখা চলবে না।
২
আসলে, স্বাধীনতার নামে দেশবিভাগ বাঙালি জাতির আদি পাপ। আর, সেই পাপের ছায়ায় আক্রান্ত বাংলা ভাষা।‘দিজ্জই কান্তা খা পুনবার পর্যায় কিংবা তারও আগে সুতনুকা প্রত্নলিপির সময় থেকে সূক্ষ্মভাবে ও বহুধা বিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষা যেভাবে বহতা নদীর মতো ক্রমশ নাব্য হয়ে উঠেছে-স্পন্দনময় লোকজীবনের ঐশ্বর্য স্বীকরণের প্রক্রিয়াই তাতে প্রমাণিত। ছোট-বড় পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আর্য-অনার্য-লৌকিক উপকরণ আত্মস্থ ও পুনর্নির্মাণ করতে করতে বাংলা ভাষা আধুনিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সংশ্লেষণের এই প্রক্রিয়ায় আধিপত্যবাদী বর্গ মাঝে মাঝে হস্তক্ষেপ করতে চায়।