পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সেদিন আক্ষেপ করছিলেন, ইংরেজি-মাধ্যম ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, থুড়ি শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে বাচ্চারা বাংলায় কথা বললে মা-বাবারা ‘আনকালচার্ড’ বলে প্রমাণিত হয়। এই লজ্জা পাওয়ার ভয়ে এখনকার সচেতন মা-বাবারা সদাসতর্ক। তবে আর বাংলা বই কে পড়বে, সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর, শিবরামের ওপর ধুলো জমবে। জমুক। সার্ক অ্যাক্সেল হ্যায় না’ গোছের ভঙ্গিতে দেখিয়ে দেওয়া যাবে ঝুড়ি-ঝুড়ি কমিক্স। না, হল। কম্পিউটার গেমস আর কেবল এনিমেশনস। তাই কফি হাউসে হোক আর বইমেলার টেবিলে হোক, তিরিশ-পঁয়তিরিশের নিচে কাউকে তীর্থের কাক হতে দেখি। ভাষার দোকানদারি এখনও করছেন মধ্যবয়স্ক ও প্রৌঢ় জনেরা।

 অতএব ভাষার ভবিষ্যৎ থাক, ভবিষ্যৎ অতীত নিয়ে কথা বলাই সমীচীন। অন্তর্জালের নব্যসংযোগ প্রকরণে সমস্তই অধিপরিসর, প্রতীত বাস্তবে ভাষাও প্রতীত। চিহ্নায়ন প্রকরণের বুদ্বুদ। ইংরেজি-মাধ্যমে যাঁরা কোনো-এক ভবিষ্যতের জন্যে মুদ্রা-উৎপাদক মানবযন্ত্রদের জড়ো করছেন আজ, ইংরেজি ভাষা নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ইংরেজিটা সাহেবসুবোরা বলে, ওটা স্ট্যাটাস-সিম্বল তাই। ইউরোপ-আমেরিকায় সেটেন্ করার জন্যে ‘স্পোকেন ইংলিশ’-এ রপ্ত হওয়া চাই। নইলে হিব্রু-জাপানিও চলত। বাংলা মানে ‘হোপলেস’দের ভাষা, তা পড়েই বা কে, লেখে-ই বা কে! ট্যাগোর-সঙ দিয়ে সাহেব-সুবোদের মধ্যে যদি ‘এলিট’ হওয়া যায়, মন্দ কী! নোবেল প্রাইজ পেয়েছিল যখন, বাংলা ভাষার মতো ‘ফানি’ ল্যাঙ্গুয়েজে লিখলেও ট্যাগোর একেবারে যা-তা ছিল না বোধহয়! এই তো বাংলা ভাষার বর্তমান হাল-হকিকৎ, তার ভবিষ্যৎ অতীত নির্ধারিত হবে আত্মঘাতী বাতুলতার নিরিখে। আর, যাঁরা প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছেন ভাষার বহমান ধারাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে, গত তিন দশকে মহামারীর মতো ব্যাপ্ত হয়ে-যাওয়া সমবেত আত্মহনন সম্পর্কেও তাদের ভাবতে হবে এখন। বাংলার প্রতি উপেক্ষা হয়ে-যাওয়া সমবেত আত্মহনন সম্পর্কেও তাদের ভাবতে হবে এখন। বাংলার প্রতি উপেক্ষা এবং ইংরেজি-কেন্দ্রিকতার প্রতি লোলুপতা মূলত সময়ের অসুখের অভিব্যক্তি। সর্বত্র ব্যাপ্ত প্রতাপের ফড়ে হওয়ার জন্যেই ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে সব নীতিবোধ ত্যাগ করে ক্যাবারে নর্তকীদের মতো নগ্ন হয়ে পড়েছে এই প্রজন্ম। স্পিলবার্গের ছবির শিশু ডায়নোসোরদের মতো পিল পিল করে অধিপরিসরের খোলা ভেঙে, শূন্য থেকে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার জন্যে, বেরিয়ে আসছে কালচারাল বাসটার্ডেরা।

 ফলে প্রশ্নটা আর বাংলা ভাষায় সীমিত নেই। প্রশ্নটা এখন নির্মানবায়ন নিয়ে। মাতৃভাষার বিপন্নতা তাই কুলশীলগোত্রহীন সময়ের বিপন্নতা। এ সময় সাংস্কৃতিক, এ সময় রাজনৈতিক। ভারতীয় উপমহাদেশে অতিদ্রুত থাবা বসিয়েছে যে বিশ্বআধিপত্যবাদের উলঙ্গ রাজার দল, তাদের কাছে ভাষা-চেতনা মূল্যবোধ কিছু ভাঙা কাচের টুকরো মাত্র। আর, তাদের পার্যদেরা নিয়েছে ধূর্ত বিদূষকের ভূমিকা। যখন

৮৪