পাতা:সরীসৃপ - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সরীসৃপ

 তবে বলিয়া দিলে সকলেরই বিশ্বাস করা উচিত যে, বাঙ্গা গ্রামের বৌ, প্রায় সাড়ে তিনশ’ মাইল লম্বা বাঁধান রাস্তার ধারে গ্রামেরই দোতালা পাকা দালানে তার বাস, ঘুমানো দূরে থাক সারাদিন সে পাঁচ মিনিট চুপ করিয়া এক জায়গায় বসিয়াছে কিনা সন্দেহ এবং সত্যসত্যই একজনের পথের দিকে চাহিয়া থাকিছে।

 কখনও সদর দরজায় দাঁড়াইয়া চাহিয়াছে, কখনও জানালার শিকের ফাঁকে চাহিয়াছে, কখনও আলিসাহীন ছাদে দাঁড়াইয়া চাহিয়াছে। পথ ছাড়া আর যা কিছু দেখিবার আছে, কিছুই দেখিতে বাদ দেয় নাই। তবে সে একরকম মূল্যহীন দেখা। অনেকদিনের অতি পরিচিত আবেষ্টনী। চোখের সঙ্গে এমন অদ্ভুত ঘনিষ্ট পরিচয় যে, নূতনত্ব সৃষ্টিই হইতে পারে না। যে দু’একখানা নতুন ঘরবাড়ী উঠিয়াছে, যে ঘরবাড়ীর সংস্কার হইয়াছে, যেখানে বন সাফ হইয়াছে, যেখানে গাছপালা নিবিড়তর হইয়াছে, যেখানে মাঠের খোলা বুক ফসলে ভরিয়া গিয়াছে, যেখানে শুকনো জমিতে জল জমিয়া আয়নার মত ঝকঝকে জলা হইয়াছে,—তার চোখের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিবার জন্য কোথাও যেন আকস্মিকতা আমল পায় নাই, সমস্ত পরিবর্তনের পিছনে তার শুভদৃষ্টির অনুমোদন লাগিয়া আছে।

 এই ব্যাপারটাই আগাগোড়া কেমন খাপছাড়া লাগে। প্রায় চুয়াল্লিশ বছর বয়সে এসব কি চলে মেয়েমানুষের! বাহিরটা ভিতরে চলিয়া আসিবে, এ বয়সে এটা আর ঠিক মানায় না, উচিত হয় না, প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। কপালে ত্রিশ বছরের সিঁদূরের ফোঁটাটা একবারও চড়চড় না করিলে যেমন অন্যায় হয়, এও কতকটা সেইরকম বই কি। সকালে, দুপুরে, বিকালে, রাত্রে, চারিপাশের জগৎকে খুঁটিয়া খুঁটিয়া ভিতরে আনা, তুচ্ছতম পরিবর্ত্তনকে পর্য্যন্ত সূচনা হইতে চিনিয়া