পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অতি সাবধানে, আস্তে আস্তে তক্তার নীচ হইতে একটা হাঁড়ি ঠেলিয়া বাহির করিল-রামপদর সেই হাঁড়িটা। তখনো তার মুখের কাছে একটুখানি মিহিদানা লাগিয়াছিল। পণ্ডিতমহাশয় ভয়ানক ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, “এ হাঁড়ি কার?” রামপদ বলিল, “আজ্ঞে, আমার।” আর কোথা যায়-অমনি দুই কানে দুই পাক! “হাঁড়িতে কি রেখেছিলি?” রামপদ তখন বুঝিতে পারিল যে গোলমালের জন্য সমস্ত দোষ তাহারই ঘাড়ে আসিয়া পড়িতেছে। সে বেচারা তাড়াতাড়ি বুঝাইতে গেল, “আ:জ্ঞ, ওর মধ্যে করে মিহিদানা এনেছিলাম, তার পর”—মুখের কথা শেষ না হইতেই পডিতমহাশয় বলিলেন, “তার পর মিহিদানাগুলো চীনে পটকা হয়ে ফুটতে লাগল-না?” বনিয়াই ঠাস ঠাস করিয়া দুই চড়।

 অন্যান্য মাস্টাররাও ক্লাশে আসিয়া জড়ো হইয়াছিলেন; তাহারও একবাক্যে হাঁ হাঁ করিয়া রুখিয়া আসিলেন। আমরা দেখিলাম বেগতিক। বিনা দোষে রামপদ বেচারী মার খায় বুঝি। এমন সময়ে দাশু আমার শ্লেটখানা লইয়া পণ্ডিতমহাশয়কে দেখাইয়া বলিল, “এই দেখুন। আপনি যখন ঘুমাচ্ছিলেন, তখন ওরা শ্লেট নিয়ে খেলা কচ্ছিল এই দেখুন, টুকটাকের ঘর কাটা।” শ্লেটের উপর আমার নাম লেখা-পণ্ডিতমহাশয় আমার উপর প্রচণ্ড এক চড় তুলিয়াই হঠাৎ কেমন থতমত খাইয়া গেলেন। তাহার পর দাশুর দিকে কটমট করিয়া তাকাইয়া বলিলেন, “চোপ্‌রও, কে বলেছে আমি ঘুমুচ্ছিলাম?” দাশু খানিকক্ষণ হাঁ করিয়া বলিল, “তবে যে আপনার নাক ডাকছিল?” পণ্ডিতমহাশয় তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরাইয়া বলিলেন, “বটে? ওরা সব খেলা কচ্ছিল? অরি তুমি কি কচ্ছিলে?” দাশু অম্লানবদনে বলিল, “আমি তো পটকায় আগুন দিচ্ছিলাম।” শুনিয়াই তো সকলের চক্ষুস্থির। ছোকরা বলে কি?

 প্রায় আধমিনিটখানেক কাহারো মুখে আর কথা নাই। তার পর পণ্ডিতমহাশয় ঘাড় বাঁকাইয়া গভীর গলায় হুংকার দিয়া বলিলেন, “কেন পটকায় আগুন দিচ্ছিলে?” দাশু ভয় পাইবার ছেলেই নয়, সে রামদপকে দেখাইয়া বলিল, “ও কেন আমায় মিহিদানা দিতে চাচ্ছিল না?” এরূপ অদ্ভুত যুক্তি শুনিয়া রামপদ বলিল, “আমার মিহিদানা আমি যা ইচ্ছা তাই করব।” দাশু তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, “তা হলে, আমার পটকা, আমিও যা ইচ্ছা তাই করব।” এরূপ পাগলের সঙ্গে আর তর্ক করা চলে না। কাজেই মাস্টারেরা সকলেই কিছু কিছু ধমকধামক করিয়া যে যার ক্লাশে চলিয়া গেলেন। সে ‘পাগলা’ বলিয়া তাহার কোনো শাস্তি হইল না।

 ছুটির পর আমরা সবাই মিলিয়া কত চেষ্টা করিয়া তাহাকে তাহার দোষ বুঝাইতে পারিলাম না। সে বলিল, “আমার পটকা রামপদর হাঁড়ি। যদি আমার দোষ হয়, তা হলে রামপদরও দোষ হয়েছে। বাস্। ওর মার খাওয়াই উচিত।”

সন্দেশ-বৈশাখ, ১৩২৪
১১২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২