পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হাত-পা ছেড়ে পড়তে পড়তে সামলে গেল—তার পর দাঁত মুখ খিচিয়ে ফিরে দেখে কেউ নেই। এরকম অদ্ভুত কাণ্ড দেখে তার ভয় হল, না কি হল, তা জানি না কিন্তু সে এক লাফে সেই যে পালাল, একেবারে বিশ-ত্রিশটা গাছ না ডিঙিয়ে আর থামল না। দক্ষিণ আমেরিকায় একরকম ফল আছে, সে এই বিদ্যাতে গিলার চাইতেও ওস্তাদ। তার ফলগুলো ফাইবার সময় বন্দুকের মতো আওয়াজ করে আর তার ভিতরকার বীচিগুলো এমন জোরে ছুটে যায় যে ভালো করে তার চোট লাগলে মানুষ পর্যন্ত জখম হতে পারে।

 ছেলেবেলায় একরকম গাছের গল্প পড়েছিলাম, তারা নাকি মানুষ ধরে টেনে খায়। কিন্তু আজকাল পণ্ডিতেরা এ কথা বিশ্বাস করেন না—কারণ, অনেক খোঁজ করেও সে গাছের কোনোরকম প্রমাণ পাওয়া যায় নি। যে গাছ পোকামাকড় খায়, সে সুযোগ পেলে পাখিটা বা ইঁদুরটা পর্যন্ত হজম করতে পারে। কিন্তু যে যদি মানুষ পর্যন্ত খেতে আরম্ভ করে তা হলে তো আর রক্ষা নেই।

সন্দেশ—পৌষ, ১৩২৪


কয়লার কথা

 আমি এক টুকরো কয়লা। রাস্তার ধারে পড়ে আছি, কেউ আমার খবর নেয় না। একটি ছোট্টো ছেলে তার মার সঙ্গে যেতে যেতে খপ করে আমায় কুড়িয়ে নিল। দেখে মা বললেন, “অরে, ছি ছি-নোংরা। ওটা ফেলে দাও।” ছেলেটা অমনি আমায় তাচ্ছিল্য করে ফেলে গেল। দেখে রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলতে লাগল। হায় রে! আমার যদি কথা কইবার শক্তি থাকত, একবার আচ্ছা করে শুনিয়ে দিতাম।

 কি শোনাতাম? কেন, আমার বয়সের কথা, আমার বংশের কথা, আমার গুণের কথা। সে কথা এখন কি আর তোমরা বিশ্বাস করবে?

 হাজার হাজার বছর আগে যখন তোমরা কেউ ছিলে না, তোমাদের মতো দু-পেয়ে জন্তুরা যখন পৃথিবীর উপর সর্দারি করতে শেখে নি, আমি তখন ছিলাম ভীষণ বড়ো জঙ্গলের প্রকাণ্ড গাছের মধ্যে। তোমরা যাকে বল ‘বনস্পতি' আমি ছিলাম সেইরকম জাঁকালো গাছের জ্যান্ত ডাল। কত যুগের পর যুগ আমরা সেখানে ছায়া দিয়েছি, কত অদ্ভুত পাখি আমার উপর বসে বিশ্রাম করেছে, কত বিদঘুটে জন্তু সেই গাছের আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু অমন যে বিরাট জঙ্গল সে ও কি চিরকাল টিঁকতে পারে? এমন দিন এল, যখন সে জঙ্গলের আর চিহ্নমাত্র রইল না। যেখানে জঙ্গল ছিল সেখানে ছাই ভস্ম ধুলা বালির চাপের নীচে, ভিজা মাটি আর বৃষ্টির জলে মরা কাঠ পচতে লাগল। কত পথ-হারানো নদীর স্রোত কত কাদামাটি জঞ্জাল এনে তার উপরে ফেলে গেল। কত ভূমিকম্পে কত আগুনের উৎপাতে সেই জমি কতবার ধ্বসে পড়ল, কতবার কেঁপে উঠল। কত পাহাড়-গলা পাথর এসে কত নতুন জমি তৈরি হল, তার উপরে নতুন মাঠ, নতুন বন, নতুন প্রাণীর খেলা চলল। আমরা যুগ যুগ ধরে তারই তলায় পচতে পচতে চাপে আর

নানা নিবন্ধ
২০৫